২০ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৬:১৪

কার লাভ আর কার ক্ষতি

কোন না কোনভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছেই। কিন্তু এ সুযোগে কার লাভ আর কার ক্ষতি এ প্রশ্ন বার বার উকি দিচ্ছে। দেশে আসলে কি পরিমান টাকা কালো আছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। এই টাকা মূলত আবাসন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে, যেখানে আবার নতুন করে কালোটাকা সৃষ্টি হচ্ছে। এই টাকা আবাসনে বিনিয়োগ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু প্লট ও ফ্ল্যাটের দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতি ভারসাম্য হারাচ্ছে।

বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা কর দিয়ে বৈধ করেছেন ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। চলতি বছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় সম্পর্কিত আইনে পরিবর্তন আসায় করদাতারা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে উৎসাহিত হয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছেন।

অনেকদিন ধরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও চলতি বছরে এ সুবিধা গ্রহণের এ উল্লম্ফন নতুন করে অর্থনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। অন্যদিকে, করোনায় সরকারের ব্যয় চাহিদা বেড়ে গেছে। এ কারণে রাজস্ব আহরণ বাড়ারও প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
অপ্রদর্শিত আয় বৈধ হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতির কি প্রকৃতপক্ষে লাভ হচ্ছে, না লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে, তা নিয়েও কোন ধরনের সঠিক ধারনা নেই।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার। তিনি বলেন, কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার অবস্থান নেয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’-এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন করার সংস্কৃতি থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য (শুল্কনীতি) মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, কালো টাকা আয়ের মূল কারণ হলো সুশাসনের অভাব। কালো টাকা উপার্জন রোধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।

সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিশেষ কর সুবিধার সুফল নিয়ে প্রশ্ন করে বলেন যে এ ধরনের সুবিধা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। তিনি বিশেষ কর সুবিধা সত্যিই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিনা, এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে গবেষণা করার পরামর্শ দেন।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ অন্যায্যবোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এ সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহয়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে এর ক্ষতির কথা তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের কালো টাকার পরিমাণ ঠিক কতো তার কোনো আনুষ্ঠানিক হিসেব নেই বা সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় না।
তবে রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ বিভাগের নানা সূত্র থেকে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য এসেছে তাতে দেখা যায় এ পর্যন্ত দেশে ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। ওই দুই অর্থ বছরে প্রায় ৩২ হাজার ব্যক্তি ওই সুযোগ নিয়ে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা বৈধ করেছিলো। আর এ যাবতকাল মোট সাদা হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং তার বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের আমলেই ২০১২-১৩ সালে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটা স্থায়ী নিয়ম তেরি করা হয়েছে। পাশাপাশি আয়কর আইনে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা ও কর দিয়ে পুঁজি বাজার ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ আছে। এমনকী পুরনো একাধিক বছরের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আছে।

দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি এই কালো টাকা নিয়ে আনুষ্ঠানিক গবেষণা করেছিলো ২০১১ সালে এবং এরপর থেকে প্রতিবছরই কালো টাকা সাদা করার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার বক্তব্য দিচ্ছে।

পেশাজীবীদের অপ্রদর্শিত আয়- চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, এনজিও খাত কিংবা এমন অনেক পেশায় চাকুরির বাইরেও পেশাগত চর্চার মাধ্যমে অর্থ আয়ের সুযোগ আছে। যেমন চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্রাকটিস করেন। এখন কোনো চিকিৎসক যদি এ থেকে পাওয়া অর্থ আয়কর রিটার্নে না দেখান তা হলে সেটি কালো টাকায় পরিণত হয়।

পাচার করা অর্থই বাংলাদেশের কালো টাকার একটি বড় অংশ বলে মনে করা হয়। দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে আবার সেই অর্থ দেশে আনার খবরও শোনা যায়। বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের মতো পাচার হয় বলে ধারণা করেন গবেষকরা।

নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা- কালোবাজারি, চোরাকারবারি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার বাজার বেশ বড় বাংলাদেশে। এসব কাজে জড়িত অর্থের পুরোটাই কালো টাকা মনে করা হয়। কারণ এগুলো বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কেউ যদি মাদক বিক্রি করে অর্থ আয় করেন তবে সেটি কালো টাকা, কারণ এগুলো আয়কর বিবরণীতে উল্লেখের সুযোগই নেই।

ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা তৈরি হয় এই প্রক্রিয়ায়। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে কাগজপত্রে অনিয়ম করে দাম বেশি বা কম দেখিয়ে করের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। এর মাধ্যমে যে অর্থ সরানো হয় সেটিই কালো টাকা। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলেছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের ২০০৫ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩৭.৭ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করার মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির করা অদৃশ্য অর্থনীতি শীর্ষক এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছিলো যে জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে এটি ওঠানামা করে।

প্রশ্ন হলো প্রতি বছরই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। কিন্তু কার স্বার্থে এতে কার কত লাভ আর কত ক্ষতি। এ প্রশ্ন বার বার উকি দিচ্ছে। তার কোন জবাব নেই। তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ হলে অর্থনীতিতে বৈষম্য কমবে এবং সৎ ব্যক্তিরা কর দিতে উৎসাহিত হবে।

https://dailysangram.com/post/452857