ফাইল ফটো, প্রতীকী
১৯ মে ২০২১, বুধবার, ৫:৪৮

অনুমোদন ছাড়াই চলছে করোনা চিকিৎসা

একটি হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করেছে অধিদপ্তর - ৮০টির মধ্যে ২৭টি তথ্য দেয় ৫৩টির অনুমোদনই নেই

বেসরকারি অনেক হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসা সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুসরণ না করেই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই দিচ্ছে করোনা রোগীদের চিকিৎসা। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই পরিচালনা করছে আইসিইউ।

রোগীদের কাছ থেকে কেবিন, শয্যা, আইসিইউ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ হারে। ক্যানুলা চার্জ, সার্ভিস চার্জ নামে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। এমনকি কোভিড চিকিৎসা সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্ত অধিদপ্তরে পাঠনোর নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ হাসপাতাল তা পাঠায় না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয় তদারকি ও নজরদারির জন্য কমিটি গঠন করে। এই কমিটি গত ৯ মে রাজধানী ঢাকার উত্তরায় রেডিক্যাল হাসপাতাল ও ক্রিসেন্ট হাসপাতাল পদির্শন করে। যেখানে এসব অনিয়ম ও অসংগতি দেখতে পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করেছে অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ৮০টির মতো বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে মাত্র ২৭টি হাসপাতাল অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে নিয়ম মেনে চিকিৎসা পরিচালনা করছে। বাকিরা এখনো অনুমোদন নেয়নি।

কমিটি এই দুই বেসরকারি হাসপাতালে সরেজমিন পরিদর্শন করে কিছু অনিয়ম দেখতে পায়। এর মধ্যে উত্তরার রেডিক্যাল হাসপাতাল গিয়ে পরিদর্শন দল দেখেন হাসপাতালটিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই কোভিড চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এ পর্যন্ত তারা কোভিড রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো তথ্যাদি অধিদপ্তরে পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেনি। যদিও কোভিড চিকিৎসা চালাতে হলে অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা থেকে অনুমোদন নিতে বারবার বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

পরিদর্শক দল এ সময় দেখেন, এই হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ (ইনটেনসিভ কোর ইউনিট-নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ইউনিট পরিচালিত হলেও মাত্র একটি ভেন্টিলেটর আছে। আইসিইউ সেবার পূর্ণাঙ্গ সুবিধা ছাড়াই তারা এটি পরিচালনা করছে। ছোট দুটি কক্ষে পাঁচটি করে শয্যা স্থাপন করে আইসিইউ ইউনিট তৈরি করা হয়েছে, যা মোটেই আইসিইউ সেবার জন্য উপযোগী নয়। মাত্র ছয়টি অক্সিজেন সিলিন্ডারের সমন্বয়ে ম্যানিফোল্ড অক্সিজেন সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যা ১০ শয্যার আইসিইউ পরিচালনার জন্য অপ্রতুল।

অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো বিপজ্জনকভাবে হাসপাতালের সামনে উন্মুক্ত স্থানে ফেলা রাখা হয়েছে। পরিদর্শনকালে হাসপাতালটিতে মাত্র একজন চিকিৎসককে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের কাছ থেকে ক্যানুলা চার্জ, সার্ভিস চার্জের নামে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। ডি-ডাইমার পরীক্ষার জন্যও অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। কোভিড পরীক্ষায় নিজস্ব আরটি-পিসিআর মেশিন না থাকলেও অন্য একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে অনুমোদনহীন স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপন করেছে।

হাসপাতাল ভবনটিতে ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমনকি সাধারণ ও করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতালে কোনো ধরনের ট্রায়াজ সিস্টেম অনুসরণ করা হয়নি।

উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল : কমিটি গত ৯ মে রাজধানীর উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল পরিদর্শন করে। এ সময় তারা দেখতে পান রোগীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত অক্সিজেন বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত ক্যানুলা চার্জ ও সার্ভিস চার্জ আদায় করা হচ্ছে। হাসপাতালে একইসঙ্গে কোভিড ও নন-কোভিড উভয় চিকিৎসা প্রদান করা হলেও কোনো ধরনের ট্রায়াজ সিস্টেম অনুসরণ করা হচ্ছে না।

এমনকি পাশাপাশি রুমে কোভিড ও নন-কোভিড আইসিইউ পরিচালনা করা হচ্ছে। হাসপাতালের প্রবেশমুখে ওয়েটিং জোনে উন্মুক্ত স্থানে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ব্লাড স্যাম্পল (রক্তের নমুনা) সংগ্রহ করা হয়। হাসপাতালটিতে অনুমোদনহীনভাবে বিদেশ যাত্রীসহ অন্যদের কোভিড নমুনা সংগ্রহ করা হয়। যদিও তাদের নিজস্ব কোনো আরটি-পিসিআর মেশিন নেই। এসব নমুনা সংগ্রহ করে তারা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনে বলে কমিটিকে জানায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি ও নজরদারির জন্য গঠিত কমিটির পরিদর্শনে প্রাপ্ত এসব অসংগতি প্রতিবেদন আকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, পরিদর্শন প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই এই দুটি হাসপাতালের একটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যটিকে অনুমোদন গ্রহণসহ সবকিছু নিয়মানুযায়ী করতে তিন দিনের সময় দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত ৩ মে, কোভিড চিকিৎসায় ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুসরণ না করা এবং অতিরিক্ত বিল আদায় প্রসঙ্গে অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিয়া একটি নির্দেশনা জারি করেন।

সেখানে বলা হয়, বেসরকারি হাসপাতালগুলো কেবিন, বেড, আইসিইউ ভাড়া দ্বিগুণ করা, সার্ভিস চার্জ/আইভি ক্যানুলা চার্জ এবং অন্যান্য নামে অতিরিক্ত বিল আদায় করছে, যা জাতীয় সংকটের সময় স্বাস্থ্যসেবার চেতনার পরিপন্থি। নির্দেশনায় অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত অক্সিজেন বিল ও অন্যান্য পরীক্ষার ফি সব বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক মালিককে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে অনুরোধ করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুসরণ না করা বা অতিরিক্ত বিল আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ক্লিনিক/হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৪ মে ‘কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি ও নজরদারির জন্য সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা।

এই সাত সদস্যের মধ্যে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম মোঘনী মাওলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শহিদুল ইসলাম, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো. হারুনুর রশিদ, অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার উপপরিচালক মো. জাহিদুল ইসলাম, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আমিনুল হক, হাসপাতাল শাখার সহকারী পরিচালক মো. হাবিব ইসমাইল ভুঁইয়া এবং মেডিকেল অফিসার মো. মাহমুদ উল্লাহ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/422100