১২ মে ২০২১, বুধবার, ২:০১

ফিলিস্তিনের ঈদ নিয়ে ভাবেনা সভ্যতা

আকাশ আর আঙ্গিনা নিয়ে আমাদের জীবন। আকাশে শাওয়ালের চাঁদ ওঠে, আমাদের জানায় ঈদের আহ্বান। কিন্তু আঙ্গিনার অবস্থা কেমন? আঙ্গিনায় কি ঈদের পরিবেশ আছে? ক্ষুদ্র অণুজীব করোনাই এখন আমাদের একমাত্র বিপদ নয়। বেশ আগে থেকেই মানবজাতির সদস্যরা আপন আপন কর্মক্ষেত্রে শুধু ভুল নয়, মারাত্মক অপরাধ ও বিকৃতকর্ম সম্পাদন করে আসছিল। তার ফল এখন মানবজাতি ভোগ করছে। বর্তমান সভ্যতায় যে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বিনোদন চর্চা হচ্ছে, তা মানববান্ধব নয়। এ বিষয়টি সভ্যতার নায়কদের উপলব্ধি করতে হবে। নয়তো করোনার মত আরো মারাত্মক বিষয়ের কবলে পড়তে হতে পারে মানবজাতিকে। তাই আঙ্গিনার দাম্ভিকদের এখন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আকাশ আমাদের রোদ-বৃষ্টি দিয়েছে, দিয়েছে আলোকিত কিতাবও। তাইতো আমরা রোজা রাখি, ঈদ করি।

ঈদ মোবারক। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সবাইকে জানাই ঈদ-শুভেচ্ছা। ঈদ মুসলিম জীবনে শুধু আনন্দ-বিনোদনের বিষয় নয়, ঈদের সাথে জড়িয়ে আছে পবিত্র চেতনা ও দায়িত্ববোধ। ঈদ তো আসলে তাদের জন্যই, যারা পবিত্র কুরআনের বার্তা উপলব্ধি করে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ মোতাবেক মাহে রমযানে সিয়াম পালনে সফল হয়েছেন। সিয়াম শুধু উপবাসের নাম নয়, সিয়ামের লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন। শুধু ‘খোদা-ভীতি’ শব্দ দিয়ে তাকওয়ার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা যায় না। তাকওয়ার ব্যঞ্জনা আরো গভীর ও ব্যাপক। আমরা বর্তমানে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাষ্ট্রীক ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যেসব সমস্যা ও সঙ্কট লক্ষ্য করছি, তার সমাধানও কিন্তু তাকওয়ার মধ্যে নিহিত। কেউ কেউ ভাবতে পারেন হয়তো বেশি বলা হয়ে গেল। কিন্তু মহান স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতার চেতনায় যারা ঘর-সংসার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তাদের উজ্জ্বল উদাহরণগুলো পর্যালোচনা করলে হয়তো আমরা বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পাব। হযরত ওমর (রা.) কোন চেতনায় বলেছিলেন, ‘আমার বোঝা আমিই বহিব সোজা’। কোন চেতনায় রাষ্ট্রের শাসক হওয়ার পরেও নিজেই খাদ্যশস্যের বোঝা বহন করে নিরন্ন দরিদ্র নাগরিকের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন? সেটা কি তাকওয়ার চেতনা নয়? এই চেতনা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বয়ং আল্লাহ সিয়ামের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- আশা করা যায় এর মাধ্যমে তোমরা তাকওয়া অর্জনে সক্ষম হবে।

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর যখন উদার আকাশে শাওয়ালের চাঁদ ওঠে তখন মুসলিম সমাজে আনন্দের ধারা বয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। কিন্তু ঈদের পরে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীক পরিমণ্ডলে যখন অনাকাক্সিক্ষত এবং অনৈতিক ঘটনা লক্ষ্য করা যায় তখন প্রশ্ন জাগে, আমরা সিয়াম ও ঈদের বার্তা গ্রহণে কতটা সক্ষম হয়েছি? পবিত্র রমযান মাসে আমরা যাকাত ও ফেতরা প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের প্রতি কর্তব্য পালনের যে শিক্ষা পাই, তা সারা বছর অব্যাহত থাকে না কেন? রমযানের রোজা তো আমাদের সংযম, জবাবদিহিতা ও মানবিকবোধের উন্মেষ ঘটিয়ে দরদী-সমাজ গঠনের চেতনা জাগ্রত করে। সেই চেতনা রমযান ও ঈদের পরে অব্যাহত রাখতে আমরা সমর্থ হচ্ছি না কেন? এমন আত্মসমালোচনা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।

সিয়াম ও কিয়ামের মাস রমযান আমরা অতিক্রম করেছি। সিয়াম ও কিয়াম আমাদের চিন্তা-চেতনা ও জীবন-যাপনে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে, তা আজ আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস যাদের কপালে জুটেছে: যারা এ মাসে স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ পালনে সক্ষম হয়েছে, শাওয়ালের ঈদের চাঁদ তো তাদের জন্য আনন্দের বার্তাই বহন করে এনেছে। কিন্তু আনন্দের এই বার্তার মধ্যে উন্নত ও পবিত্র জীবন-যাপনের লক্ষ্যে যে দায়-দায়িত্ব বহনের নির্দেশনা রয়েছে তাও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপলব্ধি, অন্বেষা ও কর্মতৎপরতার ঘাটতি থাকলে আমাদের ঈদ নিছক আনন্দ-উৎসবের স্থূল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হতে পারে। যারা সিয়াম সাধনা করেছেন, রাতের দীর্ঘ কিয়ামে স্রষ্টার বাণীকে স্মরণ করেছেন, সিজদায় অবনত হওয়ার মাধ্যমে আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, তাদের ঈদ তো শুধু আনন্দ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আমরা যদি আসলেই সিয়াম ও ঈদের বার্তাকে ধারণ করার মতো যোগ্যতা অর্জন করে থাকি, তাহলে ঈদ-পরবর্তী সময়ে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও তার ইতিবাচক প্রভাব আশা করতে পারি। এমন আশা কতটা পূরণ হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

মুসলিম মানচিত্রে এখন আশাবাদের উদাহরণ কম। আমরা হয়তো পথ হারিয়েছি। কেউ দিশা হারালে সবাই তাকে হারাতে চায়। পূর্ব জেরুসালেমে আবার ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই শতাধিক ফিলিস্তিনী ও ইসরাইলী পুলিশের ১৭ সদস্য আহত হয়েছে। আহতদের বেশিরভাগই আল-আকসা মসজিদে ছিলেন। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহল। শনিবার এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় শুক্রবার রাতে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ইসরাইলী পুলিশ সেখানে ফিলিস্তিনী মুসল্লিদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও শব্দবোমা ছোঁড়ে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলী পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোঁড়ে পাথর ও বোতল।

উল্লেখ্য যে, রোজার মাসে আল-আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনীদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের জের ধরে ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইসরাইলের দখল করা শেখ জারাহসহ পূর্ব জেরুসালেমের কয়েকটি এলাকা থেকে ফিলিস্তিনী পরিবার উচ্ছেদ করার ঘটনা। সব মিলিয়ে কয়েক সপ্তাহ থেকেই ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে শুক্রবারের সংঘর্ষে। এদিকে ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস রোজার মাসে ধর্মীয় স্থানে মুসল্লিদের ওপর ইসরাইলের কলুষিত হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। ঘটনার নিন্দা জানিয়ে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, ঐতিহাসিকভাবে শেখ জারাহ এলাকাটির বৈধ মালিক ফিলিস্তিনীরা। এ সংক্রান্ত নথিপত্র ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করবে তার দেশ। এছাড়া এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান।

উল্লেখ্য যে, ১৯৬৭ সাল থেকে পূর্ব জেরুসালেম দখল করে আছে ইসরাইল। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের মুখপাত্র রুপার্ট কোলভিলে বলেন, ইসরাইলকে অবশ্যই জোরপূর্বক উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী, যা সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, সাম্প্রতিককালে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণ ছাড়াও ফিলিস্তিনের গাজায় হামাসের অবস্থান লক্ষ্য করে প্রায়ই বিমান হামলা চালিয়ে থাকে ইসরাইলী বাহিনী। এতে বেসামরিক নারী ও শিশু নিহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে ইসরাইলের আগ্রাসন ও বর্বর হামলা অব্যাহত রয়েছে বর্তমান সভ্যতার শাসকদের চোখের সামনেই। এর কি কোনো প্রতিকার নেই? তাদের বিবেক ও বিবেচনাবোধ কী বলে? ফিলিস্তিনীদের ঈদ নিয়ে তারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?

https://dailysangram.com/post/452421