১১ মে ২০২১, মঙ্গলবার, ১:৫৭

উৎসবের অর্থনীতিতে করোনার আঘাত

অনলাইনে ২২ হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রি শেষ মুহূর্তে জমে উঠেছে ঈদ বাজার ব্যাংকে বাড়তি লেনদেন চাপ বাড়ছে

শেষ মুহুর্তে জমে উঠেছে ঈদের বাজার। মার্কেট-শপিংমল থেকে শুরু করে রাজধানীর ফুটপাতে সর্বত্র চলছে বেচাকেনা। সবার লক্ষ্য ঈদের নতুন পোশাক সামগ্রী কেনা। করোনাভীতির মধ্যে উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতিতে সারাদেশ ভাসছে ঈদের আনন্দে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, লকডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেচাকেনা করা হচ্ছে। ঈদের আর দুই-একদিন বাকি থাকতে মার্কেটে ঢল নেমেছে নগরবাসীর। সবাই সাধ্যমতো ঈদের পোশাকসহ চাহিদামতো অন্যান্য পণ্যসামগ্রী কেনাকাটা শুরু করেছেন। এতে করে চাঙ্গা হচ্ছে ঈদ বাজার। ঈদকেন্দ্রিক বেচাবিক্রিতে অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে ঈদের আগে গত রোববার ব্যাংকে চারগুণ লেনদেন হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ও আগামীকাল বুধবারও ব্যাংক খোলা থাকবে।

জানা গেছে, বেচাবিক্রি বাড়ায় ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে গতি ফিরে এসেছে। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছিল। গতবছর ঈদ বাণিজ্যে ধস নামে। ওই সময় মার্কেট-শপিংমল খোলা থাকলেও নগরবাসী করোনাভয়ে কেনাকাটায় আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু এবছর করোনাভীতির মধ্যেই নিয়ে নগরবাসী মার্কেটমুখী হয়েছেন। পোশাকের পাশাপাশি বিক্রি বেড়েছে-ফার্নিচার সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যসামগ্রী যেমনÑ টিভি ও ফ্রিজ, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, স্বর্ণ ও ইমিটেশন জুয়েলারীর গহনা, ডায়মন্ডের রিং ও নাকফুল, জুতা-স্যান্ডেল, টুপি তছবিসহ নানা পণ্য সামগ্রীর। এ কারণে ঈদ বাণিজ্য জমে উঠেছে। আগামী ১৩ কিংবা ১৪ মে সারাদেশে ঈদুল ফিতর পালিত হবে (চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করছে)। সে হিসেবে পাঁচদিন বাকি থাকতে মার্কেট-শপিংমলগুলোতে মানুষের ঢল নামছে। গত রোববার বিকেলে রাজধানীর বেশিরভাগ মার্কেটে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। মার্কেটে মানুষের উপচেপড়া ভিড় যেনো জানান দিচ্ছে, দরজায় কড়া নাড়ছে খুুশির ঈদ। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি অনেক মার্কেট-শপিংমল ও বিপণিবিতাণে উপেক্ষিত থাকছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদ সামনে রেখে পোশাকের নতুন কালেকশন বিক্রি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চাঁদ রাতের আগে বিক্রির জন্য আনা তাদের সব পোশাকসামগ্রী বিক্রি হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পুরান ঢাকার র‌্যাঙ্কিন স্ট্রীটের আড়ংয়ের শো-রুম থেকে পাঞ্জাবি কিনছিলেন গোপীবাগের বাসিন্দা আবির হাসান। তিনি বলেন, ঈদের ভাল কালেকশন ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে ছবি দেখে পোশাকটি তিনি নিতে এসেছিলেন সেটি আর কেনা সম্ভব হয়নি। বাধ্যহয়ে অন্য ব্র্যান্ডের অন্য একটি পাঞ্জাবি কিনতে হয়েছে। ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, তাদের সংগ্রহে থাকা ভাল পোশাকগুলো ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। এ কারণে নতুন করে অর্ডার করে আবার পোশাক আনতে হচ্ছে।

জানা গেছে, উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার দেশে প্রতিবছর বাড়ছে। কিন্তু করোনার কারণে গত এক বছর ধরে সেই অর্থনীতিতে কিছুটা সঙ্কট তৈরি হয়। এবারের পহেলা বৈশাখের কেনাকাটায়ও ধস ছিল। এর আগে গত বছর উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতিত বিপর্যয় তৈরি হয়। এবার এখনো ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা করা যায়নি। তবে করোনকালীন এই সময়ে এবারের জমজমাট ঈদের বাজার। ইতোমধ্যে অনলাইনে বেচাবিক্রি বেশ ভালভাবে জমে উঠেছে। এছাড়া মার্কেটগুলোতেও আশানুরূপ বেচাবিক্রির কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, লকডাউনের মধ্যে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেটগুলো চালু রাখা হয়েছে। ক্রেতাদের ভাল সারা পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, গত এক বছর করোনার কারণে দেশে বেচাবিক্রি ও ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক কম হয়েছে। তকে এবার করোনাভীতি নিয়ে ক্রেতারা মার্কেটমুখী হচ্ছেন। ফলে বেচাবিক্রিও ভাল হচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জানা গেছে, উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতির মধ্যে সবচেয়ে বড় অঙ্কের বাণিজ্য হয়ে থাকে এই রমজানের ঈদে। এরপর কোরবানির ঈদ এবং বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখেও বড় অঙ্কের বাণিজ্য হয়ে থাকে। উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতির টাকার অঙ্ক নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও এর ব্যাপ্তি যে অনেক সেটা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই।

অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনেও উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতির ভূমিকা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জামান আহমেদ বলেন, করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষের আয় উপার্জন কমে গেছে। চাপে রয়েছেন ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ঈদ কেনাকাটায় দোকানদার ব্যবসায়ীরা মুনাফা করতে পারবেন। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

এদিকে গত রোববার প্রয়োজনীয় লেনদেন সারতে ব্যাংকে ছিল গ্রাহকদের উপচে পড়া ভিড়। ব্যাংকগুলোতে সকাল থেকেই ছিল ক্যাশ কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। লেনদেনের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন সেবার বিল জমা দেয়ার লাইনও ছিল চোখে পড়ার মতো। অতিরিক্ত গ্রাহকের চাপে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের কর্মকর্তাদের বেশ চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। অনেক জায়গায় পড়তে হয়েছে সার্ভার সমস্যায়ও।

এদিকে ঈদ যে দিনই হোক, আগামী ১৩, ১৪ ও ১৫ মে ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গ্রাহকের কথা চিন্তা করে আজ মঙ্গলবার ও আগাীকাল বুধবার ব্যাংক খোলা থাকবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের রেওয়াজ হলো, ঈদের আগের দিন ব্যাংক বন্ধ থাকে। কিন্তু এবার একটু ব্যতিক্রম হয়েছে। ঈদ বৃহস্পতিবার হলেও তার আগের দিন বুধবার ব্যাংক খোলা থাকবে। ফলে ঈদের আগে আরও দুই দিন মঙ্গলবার ও বুধবার ব্যাংক খোলা থাকছে।

এদিকে ঈদের আগে তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য এবং রফতানি বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে ঢাকা মহানগরী, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, ভালুকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ব্যাংক শাখা ১০ মে এবং ১৪ মে ঈদ সাপেক্ষে ১৩ মে খোলা রাখতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মানুষের ঢল ফুটপাত থেকে মার্কেটে : মার্কেট শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাতেও ঈদের কেনাকাটা জমে উঠেছে। স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা এই ফুটপাতের ঈদ বাজার। তবে কোথাও মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। তারাও শামিল হচ্ছে ঈদের খুশিতে। ঢাকার মতিঝিল, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, মিরপুর রোড ও যাত্রাবাড়ীসহ প্রতিটি মার্কেটের সামনে হকাররা ঈদে পোশাকের পশরা সাজিয়ে বসেছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় রাস্তায় মানুষ কম থাকলেও সব বয়সী নারী-পুরুষের জন্য বাহারী রঙের বিভিন্ন ডিজাইনের জামা-কাপড় পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাতে। সারি সারি এসব দোকানগুলো থেকে প্রতিনিয়তই পছন্দমতো জামা-কাপড় ও শার্ট কিনছেন নগরবাসী। তবে এবার দাম বেশি রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। একাধিক ফুটপাতের ব্যবসায়ী জানান, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল দোকান। বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আবারও শুরু করতে পেরেছেন ব্যবসা। এছাড়া অভিজাত বসুন্ধরা শপিংমল ও যমুনা ফিউচার পার্কেও ঈদের কেনাকাটার জন্য মানুষের ঢল নেমেছে। ঢাকার মিরপুর রোডের প্রতিটি দোকানে দোকানে চলছে বেচাকেনা। এর পাশাপাশি গুলশানের ভাসাবী ও জারা ফ্যাশন ও নাবিলা ফ্যাশণ হাউজে বেচাবিক্রি জমে উঠেছে। ক্রেতারা সাধ্যমতো কেনাকাটা করছেন গভীর রাত পর্যন্ত। রাত ৮ টা পর্যন্ত মার্কেট খোলা রাখার নিয়ম থাকলেও এখন ক্রেতার চাপে গভীর রাত পর্যন্ত মার্কেট খোলা রাখতে হচ্ছে।

২২ হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রি অনলাইনে : চলতি বছর অনলাইনে বেচাবিক্রি হবে ২২ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মহামারি করোনার মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অনলাইন বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে চলমান লকডাউনের মধ্যে ঢাকাবাসীর একটি বড় অংশ ঘরে বসে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কেনাকাটা করছেন। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে তৈরিকৃত খাবারও পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনের অর্ডারে। গত বছর এ খাতে বেচাকেনা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছর তা ২২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে সরকার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান বলেন, ঈদ সামনে রেখে অলাইন বাণিজ্য এখন চাঙ্গা। বিশেষ করে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে দেশে দ্রুত ই-কমার্স বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ এই ব্যবসায় সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের সহযোগীতা করা হবে। তবে বাণিজ্যের নামে আবার প্রতারণা করলে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। এদিকটি বিচেনায় নিয়ে শিগগিরই ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২১ চূড়ান্ত করা হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার কারণে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লেনদেনও বেড়েছে। গত বছর প্রায় ১৫ শতাংশ লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়েছে। আর সাধারণ ছুটির সময়ে তা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিল। ই-ক্যাব (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) জানিয়েছে, মানুষ যেন ঘরে বসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে, সে জন্য ই-ক্যাব নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে। পণ্য ডেলিভারির সময় ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে বাড়িয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন ই-কমার্সের কার্যক্রম বড় ও মাঝারি শহরগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে এই সেবা গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/380861