১১ মে ২০২১, মঙ্গলবার, ১:৫৬

করোনায় কমেছে টাকার প্রবাহ

ঈদ অর্থনীতিতে নেই তেজ

শুধু রেমিট্যান্স ছাড়া সবকিছুই নিম্নমুখী - ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে

চলমান করোনায় বহু প্রত্যাশিত ঈদ অর্থনীতিতে তেজ নেই। শুধু রেমিট্যান্স ছাড়া সবকিছুই নিম্নমুখী। ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। পাশাপাশি সীমিত চলাচলে কমছে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কারণ সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহণ ব্যবস্থার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়েছে। ফলে হাতেগোনা দু-একটি মার্কেট ছাড়া প্রায় সবখানেই বেচাকেনা কমেছে।

আর শিল্প খাতে ওষুধ ও সিরামিক ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা নিম্নমুখী। এছাড়া চরম দুর্দিন চলছে শ্রম খাতে। বিশেষ করে পরিবহণ ও নির্মাণ শ্রমিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। সবমিলিয়ে আসন্ন ঈদের অর্থনীতিতে বেশ মন্দা চলছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, মানুষের ব্যয় বাড়াতে না পারলে অর্থনীতি চাঙা হবে না।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অর্থনীতি চাঙা করতে হলে মানুষের ব্যয় বাড়াতে হবে। আর ব্যয় বাড়ানোর জন্য আগে আয় করা দরকার। কিন্তু করোনার কারণে বড় একটি অংশের আয় কমেছে। মানুষের চলাচল সীমিত। যা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এটিই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, এর বিকল্প কিছু করার ছিল না। তবে আগামী বাজেটে কর্মসংস্থানকে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

জানা গেছে, প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ে। তবে কী পরিমাণ বাড়ে তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। তবে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হিসাব বলছে, চলতি মাসেই অর্থনীতিতে অতিরিক্ত আরও ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন। খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহণ খাতে এই বাড়তি অর্থ যোগ হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবী, দোকান কর্মচারী, পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবীদের বোনাসও এই কর্মকাণ্ডে যোগ হয়। উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন বাড়ে, তেমনি চাঙা হয় গোটা অর্থনীতি। তবে করোনার এ বছর অর্থনীতির এই তেজিভাব একেবারেই নেই। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের হিসাবে করোনায় দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। আর ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। ৭৮ শতাংশ মানুষ তাদের খরচ কমিয়েছে। এর মধ্যে ৫২ শতাংশ মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকের ঋণ বেড়েছে। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে কাজ হারানো বড় একটি অংশ কৃষিতে যোগ দিয়েছে। যা পুরো দেশের অর্থনীতিতে ভোগের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের হিসাবে দেশের মোট জিডিপির আকার হচ্ছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। তিনটি খাত থেকে এই উৎপাদন আসে। এগুলো হলো- সেবা খাত থেকে ৫৪ শতাংশ, শিল্প ৩১ এবং কৃষি খাত থেকে ১৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে কৃষি ছাড়া সেবা ও শিল্প দুটি খাতেই মন্দা। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন তার নিজস্ব একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করেছেন, রোজায় অতিরিক্ত ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন যোগ হচ্ছে। তার সমীক্ষার হিসাব মতে, পোশাকের বাজারে যোগ হচ্ছে ৩৫ হাজার ২শ কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। ধনী মানুষের দেওয়া জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। পরিবহণ খাতে অতিরিক্ত যাচ্ছে ৬৬০ কোটি টাকা। ঈদকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪ হাজার ৫শ কোটি টাকা। এছাড়া আয়ের হিসাবে সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর, ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের বোনাস। যা ঈদ অর্থনীতিতে আসে। এছাড়া আরও রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকা। ঈদের সময়ে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বাড়তি ব্যয় মেটাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু এবার সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরে বেসরকারি খাতে বোনাসের হার একেবারেই কমেছে। ৩৫ শতাংশ পোশাক কারখানায় ঈদ বোনাস দেওয়া হয়নি। তবে রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে। ঈদের মাসে রেমিট্যান্স আড়াই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্সের হার বেড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, পাচার হওয়া টাকা রেমিট্যান্স আকারে ফিরে আসছে।

অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজার : ঈদ অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে পোশাকের বাজার। এ সময় পোশাকের বেচাকেনা দোকানগুলোতে তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়। অভ্যন্তরীণ পোশাকের সবচেয়ে বড় জোগান আসছে পুরান ঢাকার উর্দু রোডের অভ্যন্তরীণ পোশাক মার্কেট থেকে। ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটসহ দেশের বিভাগ ও মফস্বল মার্কেটগুলোতে দেশি পোশাক সরবরাহ হয় এই মার্কেট থেকে। কিন্তু এবার একদিকে মার্কেট বন্ধ। কিন্তু রমজানের শেষদিকে মার্কেট খুলে দিলেও পরিবহণ বন্ধ থাকায় সারা দেশে সরবরাহে ব্যাপকভাবে বিপর্যয় এসেছে।

ভোগ্যপণ্যের বাজার : ঈদে সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিশেষ ভোজ্যতেল, মাংস, চিনি, ডাল, সেমাই এবং পেঁয়াজ উল্লেখযোগ্য। ফলে এসব পণ্যের আমদানিও বাড়ে। রোজা ও ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদা হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টন, চিনি সোয়া ২ লাখ টন থেকে পৌনে তিন লাখ টন, ডাল ৬০ হাজার টন, ছোলা ৫০ হাজার টন, খেজুর ১৩ হাজার টন, পেঁয়াজ ৩ লাখ ২৫ হাজার থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন, রসুনের চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকার জোগান দেওয়া হয়। কিন্তু এবার এই চাহিদা একেবারেই কমেছে।

দোকান কর্মচারী বোনাস : ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে সারা দেশের দোকান কর্মচারীদের বোনাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে দেশে ২০ লাখ দোকান, শপিংমল, বাণিজ্য বিতান রয়েছে। গড়ে একটি দোকানে ৩ জন করে ৬০ লাখ জনবল কাজ করছে। সংগঠনটির হিসাবে নিম্নে একজন কর্মীকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেওয়া হয়। ওই হিসাবে গড়ে বোনাস ৮ হাজার টাকা ধরে ৪ হাজার ৮শ কোটি টাকা বোনাস দেওয়া হয়। কিন্তু এবার পুরো রমজানে দোকান বন্ধ থাকায় বোনাস তো দূরের কথা, বেতনই পাচ্ছে না অনেক শ্রমিক।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/420360/