৩ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১০:২৮

সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যর্থ হতে দেবেন না

দেখা অদেখা

সালাহউদ্দিন বাবর : 

এই উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা দীর্ঘ দিন এই অঞ্চলে চলে আসছে। ব্রিটেন ও ভারতের অনুরূপ বাংলাদেশেও সংসদীয় গণতন্ত্র স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালেই এই পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার বিধান সংযোজিত হয়। মাঝে ১৯৭৫ সালে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথযাত্রা বিঘিœত হয়েছিল। সংবিধান সংশোধন করে, সংসদীয় ব্যবস্থার মূল চরিত্র পাল্টে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সংসদ। এই পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান দুই ব্যক্তি। রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি আলঙ্কারিক। তার পদটি শোভাবর্ধনকারী। মূল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারপ্রধানের হাতে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদ সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান খোদ রাষ্ট্রপতি। মন্ত্রিপরিষদ তার কাছেই জবাবদিহি করে। ১৯৯১ সালে পুনরায় বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে সর্বসম্মতভাবে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে এই পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা চলে আসছে ২৭ বছর ধরে। এই পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার ব্যাপারে জাতীয়পর্যায়ে ঐকমত্য রয়েছে। এই শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোনো ভিন্নমত বা বিতর্ক নেই। কিন্তু সংসদীয় সরকারব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং এর পরিচালনা নিয়ে তথা এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক আছে। পৃথিবীতে যেসব দেশে এই পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সেসব দেশে এই পদ্ধতি যতটা বিকশিত হয়েছে এবং সফলতা লাভ করেছে, বাংলাদেশে তা হয়নি। এই শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সরকারের তথা নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে তা অনুপস্থিত। তা ছাড়া এ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সচল রাখার জন্য প্রশিক্ষিত সংসদ সদস্য থাকতে হয়। এই ব্যবস্থা সচল না থাকার পেছনে সেই বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের স্বল্পতাও রয়েছে। সংসদ সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য বিশেষ বিধান রয়েছে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে। এ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকলে সংসদে কথা বলা সহজ নয়। সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের অবদানও। কিন্তু অনেক বিরোধী দল প্রায় সব সময়ই সংসদের বাইরে থেকেছে। সরকারি দলের মন্ত্রী ও সদস্যরাও প্রায়ই সংসদ কক্ষে অনুপস্থিত থাকেন। অনেক সময় কোরামের অভাবে সংসদ অধিবেশন বসতেও বিলম্ব হয়ে থাকে। অথচ জনগণের ভোট পেয়ে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে তারা ভূমিকা রাখবেন এটিই কাক্সিক্ষত ছিল। কিন্তু জাতির আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। জনগণ প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন করে এই মহান সংসদে তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। কিন্তু সেই প্রতিনিধিরা যদি এখানে তাদের নির্বাচনী এলাকার মানুষের অভাব-অভিযোগ সুখ-দুঃখ তুলে ধরতে ব্যর্থ হন কিংবা সংসদ অকার্যকর হওয়ার কারণে তার প্রতিবিধান না হয়, তবে জনমনে হতাশা সৃষ্টি হতে বাধ্য।


বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থা এখনো সফলতা পায়নিÑ এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর বহু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বর্তমান সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু নেই। নবম ও দশম সংসদ অর্থাৎ বর্তমান সংসদ এবং বিগত সংসদে কার্যকর বিরোধী দল ছিল না। পর পর দুটো সংসদ বিরোধী দল ছাড়া চললে সংসদীয় ব্যবস্থা অর্থবহ ও সফলতা হবে কিভাবে? সংসদের বাইরে যে প্রধান বিরোধী দল তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে এসেছে। ক্ষমতাসীনেরা সে দাবি অগ্রাহ্য করলে বিরোধী দল তথা সংসদের বাইরের প্রধান দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। এর আগেও সংসদ নির্বাচনের ঘটনা ঘটেছে। সংসদ নির্বাচন নিয়েই যদি প্রশ্ন থাকে, তবে সংসদীয় ব্যবস্থা অর্থবহ হতে পারে না। এখনো বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেনি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দশটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি নির্বাচন অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ছিল। বাকি ছয়টি নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম, কারচুপি, ভোটকেন্দ্র দখল ও জাল ভোট প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। সংসদীয় গণতন্ত্র আর যেসব কারণে সফলতা পায়নি, এ নিয়ে এখন একে একে আলোচনা করা যেতে পারে।


সংসদীয় ব্যবস্থা সফল হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সংসদ তার পূর্ণ মেয়াদ অর্থাৎ পাঁচ বছর টিকে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সংসদের সাফল্য লাভ করার ক্ষেত্রে একটি বড় শর্ত। কিন্তু রাজনীতিকদের ভুলভ্রান্তির দরুন এবং তাদের দক্ষতার অভাবে অনেক সময় সংসদ তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিকদের ভ্রান্তনীতির কারণে বেশ কয়েকবার সংসদ তার পূর্ণমেয়াদ শেষ করতে পারেনি। তারা বারবার ভুল করেছেন, প্রশাসন পরিচালনায় তাদের অদক্ষতা এবং গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সুযোগে ওঁৎ পেতে থাকা অপশক্তি ক্ষমতা দখল করে অসাংবিধানিক শাসন এ দেশে কায়েম করে। রাজনীতিকদের এসব দুর্বলতা ছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয় এবং এতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভণ্ডুল, অর্থাৎ গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশও এমন দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে। তাতে সাংবিধানিক সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছে একাধিকবার। আর এসব ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দেশের দু’জন মহান নেতা ও রাষ্ট্রপতিকে জীবন দিতে হয়েছে। দু’জন রাষ্ট্রপতির আত্মত্যাগের পরও তা থেকে দেশের রাজনীতিকেরা কোনো শিক্ষা নিতে পারেননি। ফলে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; বরং গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। জনগণের ভোটের মূল্য ধূলিসাৎ করা হয়েছে। এ ধরনের অপশাসনের যে প্রভাব তা দীর্ঘ দিন অব্যাহত।


বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব দ্রুত তৎকালীন সরকার ১৯৭২ সালে একটি চমৎকার সংবিধান জাতিকে উপহার দিয়েছিল। সে সংবিধান অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে এসে সরকার গঠন করে। তবে সে নির্বাচন যে পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল তা বলা যাবে না। আর একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে; নতুন সংবিধান প্রবর্তনের সময় দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ছিল। দেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা দেখাতে না পারায় বহু ক্ষেত্রে সব এলোমেলো হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে সঙ্কট আরো বেশি দেখা দেয়ায় ক্ষমতাসীনেরা সংসদীয় ব্যবস্থা রহিত করে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। মাত্র কিছু দিন চলার পরই সংসদীয় ব্যবস্থার ওপর এভাবে আঘাত আসে। সরকার পদ্ধতি পাল্টানোর পরও প্রশাসন পরিচালনায় তৎকালীন সরকার সফলতা অর্জন করতে পারেনি। এই ব্যর্থতা, শাসক দলের নেতাকর্মীদের নানা অনিয়ম এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে সরকারের দুর্ভাগ্যজনকভাবে পতন ঘটে। প্রথম জাতীয় সংসদ এভাবেই তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। সংসদীয় ব্যবস্থার জন্য এটি ছিল বড় আঘাত।


দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের নির্বাচন। উল্লেখ করা যেতে পারে, এ সংসদ কিন্তু সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই সংসদও তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করার সুযোগ পায়নি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক শাসক। সেই সরকারের অধীনে এবং রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার আওতায় ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন হয়। অনেক দল এই নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু এই সংসদও পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। এরপর চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। নির্বাচনটি বাংলাদেশের বেশির ভাগ দল বর্জন করে। সব প্রধান দলের সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে তৎকালীন সরকারের পতন ঘটে এবং সংসদ বাতিল হয়ে যায়।


১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সব দল অংশ নেয় এবং নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। এতে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। এই সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করলেও নানা দাবিতে বিরোধী দল আন্দোলন করে। দাবি তোলা হয় সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে সর্বসম্মতভাবে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়। এই সংসদ ছিল কার্যকর। বিরোধী দল তখন সংসদে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।


এত কিছুর পরও সংসদের বাইরে আওয়ামী লীগ কিন্তু সরকারকে যথাযথভাবে কাজ করতে দেয়নি। নানাভাবে তারা বাইরের রাজনীতিকে উত্তপ্ত রাখে। সরকার একান্তচিত্তে দেশ পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে পারেনি। পঞ্চম জাতীয় সংসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার অধীনে। কিন্তু শেষ হয়েছে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এ দেশে বহু দিন সংসদীয় ব্যবস্থা না থাকার পর পঞ্চম সংসদেই সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়। সরকার ও বিরোধী দলের বেশ কিছু বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান এই সংসদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখেন। পঞ্চম সংসদ তার মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিল।


পঞ্চম সংসদের বিরোধী দল একটি দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। জাতীয় নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবেÑ এ দাবিতে তৎকালীন সরকারি দল বিএনপি প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে। এ দিকে পঞ্চম সংসদের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। ফলে তারা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সে নির্বাচনে বলতে গেলে কোনো দলই অংশগ্রহণ করেনি। প্রায় সব আসনে বিএনপি প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ষষ্ঠ সংসদ বসার পর সেখানে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজিত হয়। সংবিধান সংশোধনের পরপরই সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ সংসদ একটি ব্যর্থ সংসদ।


সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন। এ নির্বাচনে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে বিএনপি। এই সংসদ খুব একটা প্রাণবন্ত ছিল না।
উল্লেখ করা যেতে পারে, এই সংসদ সর্বপ্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের যে গুরুত্ব এবং তাদের কার্যক্রম যতটা মসৃণ হওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু হয়নি। সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এটি ছিল দ্বিতীয় সংসদ। এই সংসদে সংসদীয় ব্যবস্থাকে যতটা কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করা উচিত ছিল তা হয়নি। ফলে সংসদীয় রাজনীতিতে সপ্তম সংসদ খুব একটা অবদান রাখতে পারেনি।


অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালের ১ অক্টোবর। নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরও বিএনপি সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন পরিচালনায় বিরোধী দলের তেমন সহযোগিতা পায়নি। বিরোধী দল আওয়ামী লীগ প্রথম থেকে সংসদ বর্জন করেছিল। সংসদে হাজির না থাকায় সংসদীয় ব্যবস্থা সফল করার ক্ষেত্রে তারা কোনো অবদান রাখেনি। একটি অসফল সংসদ হিসেবে অষ্টম সংসদ বিবেচিত হয়। আর এভাবেই এই সংসদ তার পূর্ণ মেয়াদ অতিবাহিত করে।


বাংলাদেশে নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। এ নির্বাচন হয়েছিল একটি সামরিক সরকারের অধীনে। সংবিধান অনুসারে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাস। এ তিন মাসের মধ্যে সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে তাদের বিদায় নেয়ার কথা। কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন ছিল। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ ছিল, ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনীসমর্থিত সরকার তাদের প্রতিপক্ষকে নির্বাচনে সহায়তা করেছে। এই সংসদে বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে নবম জাতীয় সংসদ সফল হয়নি। সরকারি দল ও তার সহযোগীরা এককভাবে সংসদ চালিয়েছে। এতে সরকারের কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। তাই এই সংসদকে সফল বলে ধরে নেয়ার উপায় নেই। এই সংসদ এভাবেই তার মেয়াদ শেষ করেছে।


দশম জাতীয় সংসদের (চলতি সংসদ) নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এই নির্বাচনে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। তারা দাবি করেছিলÑ ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নয়, একটি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু সরকার তাদের দাবি গ্রহণ না করায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। পরে সরকার ও তার মিত্ররা মিলে একতরফা নির্বাচন করেছে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই বিরোধী দলহীন বর্তমান দশম সংসদ গঠিত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের যে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য, তার কিছুই বর্তমান নেই। এভাবেই এখন চলছে সংসদ।


সংসদ তথা আইন বিভাগের যে প্রক্রিয়ায় নির্বাহী বিভাগ তথা সরকার জবাবদিহি করবে, তা সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এগুলো সাধারণত বিভিন্ন প্রস্তাব আকারে সংসদ সচিবালয়ে জমা দেয়া হয়। সচিবালয় সেগুলো বাছাইয়ের পর তা সংসদে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করে। প্রস্তাবগুলো সংসদে পেশের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধী দলের সদস্যদের প্রাধান্য থাকে। প্রশ্নোত্তর ও এসব প্রস্তাবের মাধ্যমেই বিরোধী দলের সদস্যরা সরকারের সব কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন; খোঁজখবর নিতে পারেন। তারা সরকারকে পরামর্শ দিতে পারেন। বাংলাদেশের সংসদে প্রতিদিনের কর্মসূচিতে প্রথমে এক ঘণ্টা নির্দিষ্ট থাকে প্রশ্নোত্তরের জন্য। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। এসব প্রশ্ন সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক ধরনের প্রশ্ন যেগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সংসদে জবাব দেন এবং এসব প্রশ্নের একাধিক সম্পূরক প্রশ্নও হয়ে থাকে। এ নিয়ে চুলচেরা আলোচনা হয়। কখনো কখনো এসব প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের সূচনাও হয়ে থাকে। আরেক ধরনের প্রশ্ন রয়েছে, যা সংসদ সদস্যরা লিখিতভাবে জবাব পেয়ে থাকেন। এসব প্রশ্ন নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। উল্লেখ করা যেতে পারে, সব প্রশ্নই সদস্যরা আগে সংসদ সচিবালয়ে জমা দেন। সেখানে বাছাইয়ের পর তা সংসদে আলোচনার জন্য আসে। প্রধানমন্ত্রীকেও সপ্তাহের নির্দিষ্ট এক দিন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিতে হয়। সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়সহ তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। প্রশ্নোত্তর পর্বটির মাধ্যমে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ আর জবাবদিহি করা যায়। সংসদে সরকারি দলের বাইরে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের সংসদীয় ভাষায় বলা হয় বেসরকারি সদস্য।


সংসদে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং বিষয় নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হতে পারে। আর বেসরকারি সদস্যদের আনীত এ ধরনের প্রস্তাবকে সংসদের স্পিকার প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এসব প্রস্তাবের মাধ্যমে সদস্যরা নানা বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান। এসব প্রস্তাব যদি সংসদে পাস হয় তবে তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সরকার বাধ্যবাধকতায় পড়ে। কোনো জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে আলোচনার জন্য কোনো সদস্য নোটিশ প্রদান করতে পারেন।


স্পিকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী যদি বিষয়টি আলোচনার ব্যাপারে সম্মত হন, তাহলে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে। এসব নোটিশের মাধ্যমে সদস্যরা অনেক বিষয়ে সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সংসদে কোনো প্রশ্ন করা হলে এবং যার উত্তরে বর্ণিত কোনো বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে বিশদ বিবরণের প্রয়োজন হয়, তাহলে কোনো সদস্য সংসদ সচিবালয়ে লিখিত নোটিশ প্রদানকালে তা নিয়ে আধা ঘণ্টা আলোচনার জন্য স্পিকার সময় বরাদ্দ করতে পারেন। এ ধরনের আলোচনায় কোনো বিষয়ে জানার প্রথা রয়েছে। কোনো জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার জন্য কোনো সদস্য মুলতবি প্রস্তাব দিতে পারেন। স্পিকার যদি তাতে অনুমোদন দেন, তাহলে সংসদের কর্মসূচি মুলতবি রেখে সে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। তা ছাড়া নতুন বছরের সূচনায় রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণ দিয়ে থাকেন। সে ভাষণের ওপর ধন্যবাদ পেশ করা হয়। তার ওপর দীর্ঘ আলোচনা হয়ে থাকে। সদস্যরা এই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। আলোচনায় সদস্যরা যেকোনো বিষয় নিয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনার সুযোগ পান। সরকারের নানান কার্যক্রম নিয়ে সদস্য আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন। অনুরূপভাবে প্রতি বছর সরকারের বাজেট পেশের পর সেই বাজেট নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়ে থাকে। এখানেও সদস্যরা স্বাধীনভাবে বাজেট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন।


সংসদ তথা আইন বিভাগের কাজ হচ্ছে, দেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের আইন পাস করা। এ ধরনের আইন প্রণয়নের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা হয়। আলোচনাকালে সংসদ সদস্যরা আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সুযোগ পান। দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো আইন যদি সরকার নিয়ে আসে, এর বিরোধিতা করা ছাড়াও প্রয়োজনে এর সংশোধনী প্রস্তাব সদস্যরা দিতে পারেন। এ ছাড়া ভিন্ন দেশের সাথে কোনো বিষয়ে সমঝোতা বা চুক্তি সংসদে পেশ করার রেওয়াজ আছে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার সুযোগ দেয়া হলে সদস্যরা তাতে যোগ দিতে পারেন। দেশের সর্বোচ্চ আইন হচ্ছে সংবিধান। সময়ের প্রয়োজনে সব দেশে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এটি সংশোধনের প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ ও জটিল। কিন্তু এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় সদস্যরা বক্তব্য রাখতে পারেন সংশোধনীর ওপর এবং নিজেরা সংশোধনী আনতে পারেন।


সংসদে সরকারের জবাবদিহি করার উল্লিখিত প্রক্রিয়াগুলো এখন আর চর্চায় নেই। সরকার এখন চলছে কোনো জবাবদিহি ব্যতিরেকে। সংসদীয় ব্যবস্থা এভাবে সফলতা পেতে পারে না। সংসদীয় ব্যবস্থার মূল চেতনাই হচ্ছে একটি কার্যকর, প্রাণবন্ত ও জবাবদিহিতামূলক সংসদ। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সংসদীয় ব্যবস্থাকে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই চলতে হবে। তা ছাড়া সংসদের সৌন্দর্য হচ্ছে সরকারের প্রতিপক্ষ বিরোধী দল। কিন্তু সংসদে এখন কার্যত বিরোধী দল নেই। বিরোধী দলই প্রকৃতপক্ষে সরকারের জবাবদিহি করে থাকে।


সংসদীয় ব্যবস্থাকে সফল করার ক্ষেত্রে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের ভূমিকা ব্যাপক। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার সরকারি দল থেকেই হয়ে থাকেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের নিরপেক্ষভাবে সংসদ চালাতে হবে। বিরোধী দল যাতে আলোচনার জন্য সময় সুযোগ ঠিকমতো পায়, সে ব্যবস্থা তাদের করতে হবে। সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে তারা যেন বাধার সৃষ্টি না করেন। তাদের সংসদের অভিভাবক হতে হবে।


সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্কটগুলো উল্লেখ করা হলো। তা উত্তরণের জন্য যদি রাজনীতিকেরা উদ্যোগী না হন, তবে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হবে। এর দায়ভার রাজনীতিকদের বহন করতে হবে। সংসদীয় ব্যবস্থা সফল করার ক্ষেত্রে একাধিক পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ। আর সে সংসদ গঠিত হতে হবে একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এমন স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটি পক্ষ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তারা ভূমিকা রাখবেন প্রশ্নহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। সংসদীয় ব্যবস্থা সফল করতে রাজনৈতিক দলকে ভূমিকা রাখতে হবে। এই রাজনীতিকেরা শুধু ক্ষমতাসীন নয়, বিরোধী দলেরও হতে হবে। অনুকূল নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ক্ষমতাসীনদের উদ্যোগী হতে হয়। বিরোধী দলের দায়িত্ব হচ্ছে, এমন নির্বাচনে অংশ নেয়া। সংসদ গঠিত হওয়ার সময় সরকারি ও বিরোধী দলকে সম্মিলিত কাজ করতে হবে যাতে সংসদ সফল হতে পারে; বিরোধী দল যাতে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়, সরকার যাতে জবাবদিহি করতে পারে, এটি নিশ্চিত করা জরুরি।

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/208990