৯ মে ২০২১, রবিবার, ৭:৪২

করোনার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে অনিশ্চয়তা ঝুলন্ত অবস্থায় লাখ লাখ মানুষ

ইচ্ছে ছিল, আজ আমার লেখার আলোচ্য বিষয় হবে ভারতের ৪টি রাজ্য বা প্রদেশ এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নির্বাচন। এই চারটি রাজ্য বা প্রদেশ হলো, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, আসাম ও কেরালা এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা রাজ্য হলো পদুচেরী। আমাদের অনেকের কাছেই পদুচেরী নামটি বিদঘুটে ঠেকে। আমরা পড়ে এসেছি এবং শুনে এসেছি পন্ডুচেরী। তবে ২০০৬ সালে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটিকে নতুন নামে ডাকা হয় পদুচেরী নামে। এই নির্বাচন নিয়েই লিখবো। কিন্তু এর মধ্যে করোনা এবং এর টিকা নিয়ে যে তেলেসমাতি কারবার চলছে সেটি একটি প্রচণ্ড জনদুর্ভোগের ব্যাপার। কাজেই সে বিষয়ে কিছু না লিখলেই নয়।

আপনারা সকলেই জানেন যে গত ২৬ এপ্রিল থেকে করোনার প্রথম ডোজের টিকা দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, টিকার ঘাটতি বা কমতি। ভারত থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করা হয়েছে। তার মধ্যে দেড় কোটি ডোজের মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। এই দেড় কোটি ডোজের মধ্যে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ এসেছে। আরও ৩১ লাখ ডোজ এসেছে উপহার হিসাবে। এসব কথা আপনারা সকলেই জানেন। আপনারা এও জানেন যে টিকার অভাবে গত ২৬ এপ্রিল থেকে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া বন্ধ হয়েছে। তবে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন চলছিল। সরকারের সম্ভবত: ধারণা ছিল যে এর মধ্যে হয়তো টিকা এসে পড়বে। কিন্তু সরকারের প্রত্যাশা মত টিকা আসে নাই। তাই নতুন করে নিবন্ধন করাও বন্ধ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক প্রফেসর রোবেদ আমীন বলেন, প্রথম ডোজ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫১৪ জন দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাবেন না। আর এ কারণে নতুন করে টিকার নিবন্ধন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, টিকার মওজুদের সাথে মিলিয়ে দেখা গেছে, ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫১৪ ডোজের ঘাটতি রয়েছে। রোবেদ আমীন ঘাটতির হিসাবটা আরো স্পষ্ট করে দেন এইভাবে:-

তিনি বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে টিকা নিয়েছেন ৮৯ লাখ ২৬ হাজার ৪৬৬ জন। এখনো দ্বিতীয় ডোজ নেয়া বাকী আছে ২৭ লাখ ১৩ হাজার ৪৮ জন। দেশে এখন মওজুদ টিকা আছে ১২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৩৪ ডোজ। এ কারণে টিকার দ্বিতীয় ডোজে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫১৪ জন। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ঈদুল ফিতরের আগেই চীন থেকে টিকা আসার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। তারা আশা করছেন যে রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক-ভি আসবে জি-টু-জি ভিত্তিতে। অর্থাৎ সরকার থেকে সরকারের কাছে। কোনো ভায়া মিডিয়া বা মধ্যস্বত্বভোগী নাই।

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ সেটা চিন্তা করুন যে যারা প্রথম ডোজ নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজের খবর নাই, এমন মানুষের সংখ্যা সাড়ে ১৪ লক্ষ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বয়ানেই জানা গেল যে তারা ভারতের নিকট থেকে পাওনা ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজের মধ্যে অন্তত: ৩০ লাখ ডোজ দেয়ার জন্য সেরামকে অনুরোধ করেছিলেন। সেরামের এমডি এবং সিইও লন্ডনে চম্পট দিয়েছেন। লন্ডনে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, ভারত সরকারের পারমিশন লাগবে। ভারত সরকারের পারমিশন চাওয়া হয়েছিল কিনা, সে ব্যাপারে সরকারের মন্ত্রী মিনিস্টাররা কিছু বলছেন না। কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা লিখছেন এবং টেলিভিশনে বলছেন যে এখন ভারত থেকে কোনো টিকা পাওয়া যাবে না।

॥ দুই ॥
এই অবস্থা দেখে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন যে, আগে বলেছিলাম, শুধু ভারতের ওপর নির্ভর করোনা, অন্য সূত্রও দেখো। কিন্তু তারা (সরকার) আমাদের কথা শোনেনি। তার ভাষা উদ্ধৃত করে বলছি, “এখন এর পায়ে ধরে, তখন ওর পায়ে ধরে। কিন্তু টিকা আনতে পারছে না।” যেখানে ২ কোটি ৩০ লাখ টিকা পাওনা আছে, তার মধ্যে আবার দেড় কোটি ডোজের মূল্য পরিশোধ করা আছে, সেখানে (অর্থাৎ পরিশোধিত মূল্য থেকেও ৮০ লাখ ডোজ পাওনা) আজ ৪০ লাখ এ্যাস্ট্রাজেনেকার জন্য ধর্ণা দিতে হচ্ছে আমেরিকায়। আবার ২০ লাখ এ্যাস্ট্রাজেনেকার জন্য ধর্ণা দিতে হচ্ছে বৃটেনের কাছে। চিন্তা করুন, বাংলাদেশের কি করুন, অসহায় পরিণতি! কার এই করুণ অসহায় পরিণতি? অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের। কে বা কারা এজন্য দায়ী? আমরা এই পরিণতির জন্য ভারতকে দায়ী করবো না। কারণ প্রত্যেকেই তো তার নিজের স্বার্থ আগে দেখবে। বিদেশের ক্ষেত্রে এটা রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক কূটনীতির পরিভাষায় বলা হয়, Everybody is guided by his enlightened self interest. অর্থাৎ প্রত্যেকেই তার বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত হয়। আজ আমেরিকা থেকে মডার্নার টিকার জন্য বাংলাদেশের এক ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানীকে দিয়ে তদবীর করতে হয়। কিন্তু তারপরেও সেই টিকা মেলেনা। অথচ আমেরিকার পরিবেশমন্ত্রী জন কেরী সেদিন যখন ঢাকা এসেছিলেন তখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে জানতে চেয়েছিলেন যে বাংলাদেশের টিকার প্রয়োজন আছে কিনা। তখন সরকার কোনো ইতিবাচক জবাব দেয়নি। জন কেরী কিন্তু একজন সাধারণ মন্ত্রী নন। ইতোপূর্বে তিনি জর্জ বুশের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেদিন সরকার গা করেনি।

গত ৬ মে একটি ইংরেজী জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে যে সরকার আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আরো কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে কর্মরত আমাদের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারদের কাছে জরুরি নির্দেশ পাঠিয়েছে। রাষ্ট্রদূতরা ঐসব দেশের কর্তৃপক্ষকে বলবেন যে তারা তাদের এ্যাস্ট্রাজেনেকার অব্যবহৃত মওজুদ থেকে কিছু টিকা বাংলাদেশকে দিতে পারবে কিনা। ঐ রিপোর্ট মোতাবেক, আমেরিকা এবং বৃটেন বলেছে যে তারা বাংলাদেশের অনুরোধ বিবেচনা করে দেখবে। কিন্তু তার আগে তারা ভারত এবং ব্রাজিলের চাহিদাকে অধিকতর গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে।

আমরা একটু আগেই বলেছি যে প্রয়োজনটা তো আমাদের। ভারতের দোষ দিয়ে কি লাভ? ভারতের সাথে না হয় তিন কোটি ডোজের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষ তো ১৭ কোটি। এদের মধ্যে শিশু, স্তন্যদানকারী মাতা এবং গর্ভবতী মহিলাদেরকে বাদ দিলেও বাংলাদেশের প্রয়োজন ১৩ কোটি ডোজ। এই ১৩ কোটির মধ্যে সেরামের ৩ কোটি বাদ দিলেও বাংলাদেশের প্রয়োজন আরো ১০ কোটি ডোজ। এই ১০ কোটি ডোজ সংগ্রহের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি কেন? নাকি ঐ ১০ কোটি ডোজের জন্যও কর্তৃপক্ষ মনে মনে ভারতের ওপর নির্ভর করে বসেছিলেন?

॥ তিন ॥
সবকিছুর উর্ধ্বে একটি কথা বলতেই হয়। সেটি হলো, বাংলাদেশের ওপর আল্লাহ্ তায়ালার বিশেষ রহমত রয়েছে। না হলে বৃহস্পতিবার ৭ মে বাংলাদেশে যেখানে সংক্রমিত ১৮২২ এবং মৃত্যু ৪১ জনের সেখানে পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে একই দিন সংক্রমণ ১৮ হাজার ১০২ এবং মৃত্যু ১০৩ জনের। অথচ দেখুন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি এবং পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা সাড়ে ১০ কোটি। বাংলাদেশের সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের অভিন্ন সীমান্ত। পশ্চিমবঙ্গে ডাবল ও ট্রিপল মিউটেশনের করোনাও ধরা পড়েছে। কিন্তু সেটা বাংলাদেশে হয়নি। সুতরাং আসুন, আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করি, অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশকে অনেক ভালো রাখার জন্য।

সংগ্রামের সুপ্রিয় পাঠক পাঠিকা ভাই বোনেরা, ভারতের রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনের ওপর আজ আর লেখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ শুক্রবার সকালে কম্পিউটার খুলে দেখি, নেপালে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢুকেছে। ফলে যে নেপালে বলতে গেলে করোনা ছিলই না, সেই নেপালেও করোনার ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। একমাস আগেও নেপালে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা যেখানে ছিল ১০০, এখন সেখানে দৈনিক সংক্রমণ ৮ হাজার ৬০০ দাড়িয়েছে। নেপাল রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে দিয়েছেন যে যদি অবিলম্বে শক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে নেপালেও ভারতের মত ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

এই সাথে আরেকটি উদ্বেগজনক সংবাদ হলো এই যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নাকি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ৩ টি কেস পাওয়া গেছে। তবে সেটি কি সীমান্তের ওপারে অর্থাৎ ভারতীয় এলাকায়, নাকি বাংলাদেশের এলাকায় সেটি ঐ রিপোর্টে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। যখন এই রিপোর্টটি লিখছি তখন বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমেছে। তবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকে তাহলে গুরুতর চিন্তার বিষয়।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. এ্যান্থনী ফাউচির একটি বক্তব্য পড়লাম। ভারতের করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে তিনি কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। খোদা না খাস্তা, বাংলাদেশে যদি ঈদের পরে খারাপের দিকে যায় তাহলে ড. ফাউচির এসব সুপারিশ বাংলাদেশেরও কাজে লাগবে।

তিনি ভারতের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি এবং কঠোর লকডাউন জারী করতে হবে। গত বছর শীতের শুরুতে আমেরিকায় যে অবস্থা হয়েছিল, ভারতের অবস্থা তার থেকেও খারাপ। এর জন্য তার ভাষায় ‘শৃঙ্খল ভাঙতে হবে’। শৃঙ্খল ভাঙা বলতে তিনি লকডাউন বোঝান। তিনি বলেন, ৬ মাসের জন্য না হোক, অন্তত: ৪/৬ সপ্তাহের জন্য হলেও লকডাউন জারী করতে হবে। তিনি বলেন, মহামারির শুরুতে চীনকে দেখেছিলাম, কিভাবে দ্রুত হাসপাতাল বানিয়েছিল। ভারতেরও উচিত, এরকম হাসপাতাল বানানো। এ কাজে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। আমেরিকায় আমরা দেখেছি, কিভাবে ন্যাশনাল কোস্ট গার্ড দেশের সব জায়গায় টিকা পৌছে দিতে সাহায্য করেছে। ভারতও সেই পথে হাঁটতে পারে।

বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। তৃতীয় ঢেউ আঘাত করবে কিনা আমরা জানি না। সেটা না জানলাম, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির যাতে আর অবনতি না ঘটে।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/452122