৮ মে ২০২১, শনিবার, ৭:৩২

হায়রে সেই বিছুটির ডলা!

কী দরকার ছিল ৩৩৩ নম্বরে কল দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করবার? বিপদ যে নিজের ঘাড়ে এসে চেপে বসবে তা বেচারাদের ভাবনাতেই ছিল না। কিন্তু যা ঘটবার তাতো ঘটেই গেল। কারণ ভূত এসে ওঁদের ঘাড়ে বসেই ছিল যেন।

ঘটনাস্থল উত্তরের জনপদ গারোপাহাড় সংলগ্ন নেত্রকোনা জেলা। ত্রাণ পাবার উপযোগী নন তাঁরা। একজন ঠিকাদার মানে কন্ট্রাক্টর। অন্যজন ব্যবসায়ী অর্থাৎ বিজনেসম্যান। খবরে তাঁদের ছবি দেয়া হয়েছে। তবে নামোল্লেখ করা হয়নি। ধরুন ঠিকাদারের নাম নজিরউদ্দিন বিশ্বাস। আর ব্যবসায়ীর নাম ফজিরউদ্দিন বণিক। মহামারি করোনার দাপটে মানুষ নাস্তানাবুদ হলেও ঠিকাদার কিংবা ব্যবসায়ীদের তেমন অসুবিধে নেই। ভালোই আছেন তাঁরা। অবশ্য সব ব্যবসায়ী কিংবা ঠিকাদার ভালো আছেন তা বলছি না। তবে নেত্রকোনার নজির ঠিকাদার আর ফজির বণিক ভালোই ছিলেন। একটু মজা করতে গিয়ে ধরা খেলেন। হ্যাঁ, ধরা খাবারই কথা। কারণ কাজটা করা তাঁদের মোটেই ভালো হয়নি।

কী করেছেন তাঁরা? হ্যাঁ, সেটাই বলছি। প্রশাসনের তরফ থেকে করোনাকালে বসে থাকা বেকার দুস্থদের মাঝে খাবার পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। যাতে তাঁদের কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব করা যায়। যাদের খাবার দরকার তাঁরা ৩৩৩ নম্বরে কল দিলে খাবার পৌঁছে দেয়া হয়। এমন কার্যক্রমই চলছিল সেদিন নেত্রকোনায়।

মজা করে ৩৩৩ নম্বরে কল দিয়ে নজির আর ফজির সরকারি ত্রাণ চান। এরপর রাতের আঁধারে প্রশাসনের লোকজন ত্রাণ নিয়ে হাজির হন ওই দুই কলারের বাড়িতে। ত্রাণদাতারাতো অবাক। ভালো বাড়িঘর। সবকিছু ফিটফাট। এঁরা ত্রাণ চাইবেন কেন?

নজির ঠিকাদার আর ফজির বণিক ভাবেননি সরকারি লোকজন তাঁদের জন্য সত্যি সত্যি ত্রাণ নিয়ে হাজির হবেন।

পরে নজির আর ফজির জানান, আসলে ত্রাণসামগ্রীর প্রয়োজন নেই তাঁদের। শুধু মজা করতে কল দিয়েছিলেন। রিলিফ টিমে হয়তো ডিসি, এসপি এবং আরও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে নজির ঠিকাদার ও ফজির বণিককে ২৮ হাজার টাকা জরিমানা এবং একজনকে অন্যজনের কান ধরে ওঠবস করানো হয়। এভাবেই নজির আর ফজিরকে ভূতে প্যাঁদানি দিল।

মানুষ সুখে থাকলে মাঝেমধ্যে মাথায় কুমতলব খেলে। নজির আর ফজিরের মাথায়ও তাই খেলেছিল। প্যাঁদানি অবশ্য ভূতে দেয়নি। ওঁরা ধরা খেলেন প্রশাসনের কাছে। নজির আর ফজিরকে ভূতে কিলিয়েছে মানে ওঁরা চুলকিয়ে ঘা করেছিলেন। মজা করতে গিয়ে উচিত সাজা জুটেছে কপালে।

ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীর মাত্র ২৮ হাজার টাকা জরিমানা খুব বেশি নয়। তবে পরস্পরের কানধরে ওঠবস করানো এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়াটা যথেষ্ট অপমানজনক ও অমর্যাদাকর।

মহামারি করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে সারা দুনিয়া বলা যায় লণ্ডভণ্ড। ইতোমধ্যে ৩২ লাখের বেশি আদম সন্তান মারা গেছেন। প্রতিদিনই ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৬ কোটির অধিক। করোনা পৃথিবীবাসিকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে তা বলা কঠিন। সরকারসহ কোনও কোনও সামাজিক সংগঠন করোনাকালে সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করছে। এটা নিশ্চয়ই ভালো কাজ। মহৎ উদ্যোগ। এ নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা অনুচিত। অমানবিকও। মানুষের এমন দুর্দিনে কোনও মানুষের মশকরা বা মজা করা নিশ্চয়ই গর্হিত কাজ। নেত্রকোনার নজির ও ফজির যা করেছেন তা অন্যায় এবং অনভিপ্রেত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যা করেছেন তা যথার্থ হয়েছে। আমরা তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
হাসি-তামাশা, মশকরা ইত্যাদি কখনও কখনও আনন্দ দেয় বটে। তবে মাঝেমধ্যে তা বিপদের কারণও হতে পারে। যেমন ঘটেছে নজির ও ফজিরের বেলায়। তাই সবকিছুর একটা সীমা-সহরত থাকা চাই। মাত্রাজ্ঞান অতিক্রম করলে সামান্য বিষয়ও বিপজ্জনক হতে পারে।

নজির আর ফজিরের মজা করতে গিয়ে বিপদে পড়বার ঘটনাটি আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে করিয়ে দিল। ঘটনাটা এ রকম: স্কুলে যেতে শুরু করেছি। আমার এক প্রতিবেশী কাকা জমিতে রোপণের জন্য ধানের চারা বা বিছন তুলছিলেন। আমি মজা করতে গিয়ে পেছন দিক থেকে তাঁর উদোম গায়ে বিছুটিপাতা লেপটে দিয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে দূরে সরে পড়ি। এরপর কাকার ছটপটানি দেখে কে! তারপর যা ঘটবার ঘটে যায়। আমিও বুঝে উঠতে পারিনি যে বিছুটির যন্ত্রণা কতটা মারাত্মক। কাকা রাগের চোটে টং হয়ে একটা আস্ত বিছুটি গাছ তুলে নিয়ে আমাকে ধাওয়া দিয়ে ধরে ফেলেন। তারপর আমার সারাশরীরে বিছুটিগাছটি বেশ করে ঘঁষে দিলেন। কাকুতি-মিনতিতে কোনও কাজ হলো না। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে ছুটে গেলাম। ঘটনার বিবরণ শুনে মাও যথেষ্ট বকাঝকা করলেন আমাকে। প্যাঁদানিও খেলাম। তারপরও মায়ের মনতো। তেঁতুলগোলা ইত্যাদি শরীরে মেখে যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করা হলো। সেদিন যেশিক্ষা পেয়েছি তা আজ ষাটোর্ধ্ব বয়সেও ভুলিনি। ভুলতে পারিনি। ভুলবার কথাও না। আমার মনে হয় সেদিন আমাকেও ভূতে কিলিয়েছিল। তা না হলে বেচারার গায়ে বিছুটির ডালপাতা লেপটে দিতে যাবো কেন!

ওই প্রতিবেশী কাকা যদ্দিন বেঁচে ছিলেন প্রায় তদ্দিনই আমাকে দেখলে মনে করিয়ে দিতেন ঘটনার কথা। বলতেন, “কি কাগু, মনে আছে বিছুটির ডলা?”
আমিও হাসতে হাসতে বহুদিন সায় দিয়ে বলেছি, “জি কাগা, আপনার মনে আছেতো?”

নেত্রকোনার নজির আর ফজির মজা করতে গিয়ে যে পারস্পরিক কানডলাডলির সাজা পেয়েছেন সেটা কি খুব ভয়াবহ ছিল আমি যেসাজা পেয়েছিলাম শৈশবে, তার চাইতে? নিশ্চয়ই না। আমি যদি নেত্রকোনার প্রশাসনে থাকতাম এ সময় তাহলে হয়তো সেই বিছুটিপাতার শাস্তিটা প্রয়োগ করতাম। বেচারা নজির আর ফজির বুঝতেন যখন তখন মজা করবার পরিণতি কতবড় ভয়ঙ্কর হতে পারে।

https://dailysangram.com/post/452012