৫ মে ২০২১, বুধবার, ২:৪০

কিভাবে খুলবে বিশ্ববিদ্যালয়

করোনা পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক

গত ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে আগামী ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৭ মে থেকে হলগুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। তবে এর আগেই আবাসিক হলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের করোনার টিকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু সেই ঘোষণার দুই মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত টিকা পেয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে টিকার সংকটে প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ দেশে এখন দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ফেব্রুয়ারির চেয়ে অনেক বেশি। রয়েছে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কও। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খোলার তারিখ পিছিয়ে যেতে পারে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্র জানায়, বর্তমানে করোনার যে অবস্থা তাতে ১৫-২০ দিনে খুব বেশি উন্নতি হওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত ঈদের ছুটি রয়েছে। এখনো বেশির ভাগ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী টিকা পাননি। এসব বিবেচনায় নিয়ে আবাসিক হল ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখ পেছানোর কথা চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এর মধ্যে যদি করোনার টিকার বড় চালান চলে আসে এবং অধিকসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যেতে পারে। আজ বুধবার সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ভর্তিসংক্রান্ত বৈঠক রয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়টিও আলোচনা করা হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে থাকেন মোট এক লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। আর শিক্ষক আছেন প্রায় ১৫ হাজার। যাঁদের ২৪ মের আগে টিকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কতজন শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছেন, সে তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হাতে নেই।

ইউজিসি সূত্র জানায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গত এপ্রিলের শুরুতেই তারা শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব শিক্ষার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর পাঠাতে বললেও প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষার্থীর পরিচয়পত্র নম্বর পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবাসিক হলে থাকা শিক্ষার্থীদের তালিকা আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। যেসব শিক্ষার্থী জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়েছে, তাদের অনেকেই টিকা নিয়েছে বলে জেনেছি। তবে কভিড পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য আশার বিষয়। আগামী আরো এক সপ্তাহ আমরা পরিস্থিতি দেখব। এর মধ্যে আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’

এদিকে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে আগামী ১৭ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির আবাসিক হল খোলার সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কভিড পরিস্থিতি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকাদান কার্যক্রম বিবেচনা করে আবাসিক হল খোলার কথা ভাবা হবে।’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার নামের তালিকা ইউজিসিতে পাঠিয়েছি। কিন্তু কারা টিকা পেয়েছে, সে তথ্য জানতে পারিনি। এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সময় চলে এসেছে, তাই আবারও আমরা ইউজিসি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী ২৩ মে পর্যন্ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজা ও ঈদের ছুটি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিল রেখে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নেব।’

এদিকে প্রায় ১৪ মাস ধরে বন্ধ থাকায় বড় ধরনের সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অনলাইন ক্লাস চললেও পরীক্ষা না থাকায় অনেকটাই গতি হারিয়ে ফেলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনেকেরই এসব ক্লাসে অংশগ্রহণের আগ্রহ নেই। আবার প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকা, ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণেও অনেকেই ক্লাসে অংশ নিতে পারছেন না। যদিও ঈদের ছুটিতে এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসও বন্ধ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন ব্যাবহারিকনির্ভর উচ্চশিক্ষা। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ব্যাবহারিক ক্লাস না করে অনেকটাই অন্ধকারে আছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সীমিত হয়ে এসেছে গবেষণা ও প্রকাশনা।

ইউজিসি সূত্র জানায়, দেশের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪১ লাখ। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। আর ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রায় চার লাখ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত দুই হাজার ২৫৮টি কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ লাখ। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ লাখ। আর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন আরো প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৪ মাসে উচ্চশিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে সমপরিমাণ সময় লাগবে। ফলে গত এক দশকে সেশনজট যে অনেকাংশে কমে এসেছিল, করোনায় আবারও তা ফিরে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৪ মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বড় সেশনজটে পড়বে। এতে তাঁদের ডিগ্রি পেতে দেরি হবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স পিছিয়ে পড়বে। আর অভিভাবকদের অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। রাষ্ট্রও কিন্তু কর্মক্ষেত্রে মেধাবীদের পাবে না। কারণ যাঁরা আগের বছর নিয়োগ পাননি, তাঁদের এবার নিয়োগ দিতে হবে। ফলে মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মচারী পাবে না রাষ্ট্র।’

করোনার এই সময় শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থী। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের ধীরগতি, ডিজিটাল ডিভাইসের অভাবসহ নানা কারণে অনলাইন ক্লাস সেভাবে চালু করতে পারেনি কলেজগুলো। ফলে আগে থেকেই সেশনজটে থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা সামনে আরো দীর্ঘায়িত হবে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবাই মূলত অনিয়মিত। তাঁদের পড়ালেখায় মানের বালাই নেই। করোনায় তাঁদের পাশাপাশি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মাদরাসার পড়ালেখাও প্রায় বন্ধ।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস হলেও সেখানে নানা কারণেই অতটা সফল হওয়া সম্ভব হয়নি। আর অনলাইন ক্লাসে ব্যাবহারিকের সুযোগ নেই। এই সময়ে গবেষণা ও প্রকাশনায়ও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষতি হয়তো আমরা প্রকাশ্যে দেখতে পারছি না, কিন্তু সার্বিকভাবেই এটা একটা বিশাল ক্ষতি। এটা পোষানো কষ্টকর হয়ে পড়বে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/05/05/1030498