৩ মে ২০২১, সোমবার, ২:২৬

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা

মাত্র ২% ব্যবসায়ী মনে করে অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে; ৬৯% ব্যবসায়ী সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ পাননি

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা দারুণভাবে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। ব্যবসার ওপর আস্থাও অনেকখানি কমে গেছে ব্যবসায়ীদের। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে মাত্র ২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন অর্থনীতি শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে। মাঝারি মানের পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন ৩১% এবং দুর্বল মানের পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী।

ও দিকে ৬৯ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার প্যাকেজের কোনো কিছুই তারা পাননি। এ জন্য প্যাকেজ বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রিতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন। তবে এই প্যাকেজের সুবিধা যারা পুরোটা পেয়েছেন তাদের বেশির ভাগই বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। যাদের আবার সরকারের নীতিনির্ধারকদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। করোনা মহামারীর সময়ে ব্যবসায় আস্থা সংক্রান্ত জরিপের চতুর্থ পর্যায়ের ফলাফল নিয়ে সানেম ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের ওয়েবিনারে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আস্থা ও প্রত্যাশার ওপরে সানেম ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত চতুর্থ পর্যায়ের জরিপের ফলাফল গতকাল এক ওয়েবনিয়ারে প্রকাশ করা হয়। ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। আলোচক হিসেবে ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান।

জরিপের ফলাফল উপস্থাপনে ড. সেলিম রায়হান তৃতীয় পর্যায়ের জরিপ সম্পর্কে ধারণা দেন। বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের ৩৬টি জেলার মোট ৫০৩টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৩টি উৎপাদন খাতের এবং ২৫০টি সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান। উৎপাদন খাতের তৈরী পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা প্রকৌশল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেবা খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, আইসিটি ও টেলিকমিউনিকেশন, আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট খাত জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২১ সালের এপ্রিলের ৬ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদাধিকারীদের সাথে ফোনালাপের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।

জরিপে দেখা যায় ২০২০ সালের এপ্রিল-জুন সময়কালে বার্ষিক প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্সের মান ছিল ২৬.৪৪, ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ছিল ৩৪.২৩, ২০২০ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে ছিল ৩৬.৫০ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চে হয়েছে ৪০.৫৫। এই সময়কালে ব্যবসার খরচ সংক্রান্ত সূচকের সবচেয়ে অবনতি হয়েছে। প্রেজেন্ট বার্ষিক বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্সকে খাতভিত্তিক বিবেচনায় নিয়ে দেখা যায় যে ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়কালে আর্থিক, ফার্মাসিউটিক্যাল, টেক্সটাইল ও খুচরা ব্যবসা তুলনামূলকভাবে অন্য খাতের চেয়ে ভালো করেছে; পিছিয়ে আছে পরিবহন, রেস্টুরেন্ট, চামড়া শিল্প, হালকা প্রকৌশল শিল্প ও রিয়েল এস্টেট খাত।

২০২০ সালের এপ্রিল-জুন সময়কালে ত্রৈমাসিক প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্সের মান ছিল ২৯.৪৮, ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৭.৯৬, ২০২০ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে ছিল ৪৮.৮৩ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চে হয়েছে ৫১.৩৮।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে পরিচালিত তৃতীয় পর্যায়ের জরিপের তুলনায় ২০২১ সালের এপ্রিলে পরিচালিত চতুর্থ পর্যায়ের জরিপে দেখা যাচ্ছে যে ব্যবসায়ীদের ব্যবসার আস্থা অনেকখানি কমে গিয়েছে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে পরিচালিত জরিপে বিজনেস কনফিডেন্স ইনডেক্স বা ব্যবসার আস্থা সূচকের মান ছিল ৫১.০৬, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে পরিচালিত জরিপে এই সূচক ছিল ৫৫.২৪, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে এই সূচক ছিল ৫৭.৯০ এবং ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে পরিচালিত চতুর্থ পর্যায়ের জরিপে এই সূচক ছিল ৪১.৩৯। চতুর্থপর্যায়ের জরিপে দেখা গিয়েছে হালকা প্রকৌশল, পরিবহন এবং রেস্টুরেন্ট খাতের ব্যবসায় আস্থা সবচেয়ে কম। চতুর্থ পর্যায়ের জরিপে দেখা গিয়েছে যে, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার আস্থা সূচক ৩৯.০২, মাঝারি প্রতিস্থানের ৪০.৮৩ এবং বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ৪৬.৬১।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে পরিচালিত এই জরিপের অংশ নেয়া ২২ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন তারা প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেয়েছেন। ৬৯ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন তারা প্রণোদনা প্যাকেজ পাননি এবং ৯ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন তারা প্যাকেজ সম্পর্কে জানেন না। জরিপকৃত বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ পেয়েছে ৪৬ শতাংশ, মাঝারি ৩০ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ ক্ষুদ্র ও ছোট প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা পেয়েছে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে মাত্র ২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন অর্থনীতি শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে। মাঝারি মানের পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন ৩১% এবং দুর্বল মানের পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী।

জরিপে পাওয়া তথ্যাবলি থেকে ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ‘এনাবলিং বিজনেস এনভায়রনমেন্ট ইনডেক্স (ইবিআই)’ তৈরি করা হয়েছে। সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ, পরিবহন, দক্ষ শ্রমিক, প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশন, অর্থায়নের সুবিধা, কর ব্যবস্থা, লজিস্টিক্স, দুর্নীতি, সরকারি নীতি সহায়তা এবং করোনাভাইরাস মহামারীর ব্যবস্থাপনা। ইন্ডেক্সটির মানদ ০ থেকে ১০০ এর মধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছর প্রথম প্রান্তিকে বড় ধসের পরে আমরা সার্বিক পুনরুদ্ধার দেখতে পেয়েছি, দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগ পর্যন্ত ধারাবাহিক পুনরুদ্ধার দেখা গেছে। কিন্তু পুনরুদ্ধার সবার জন্য একরকম হয়নি। আর্থিক, পোশাকখাত, আইসিটিখাত এবং বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি ভালো করেছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতে ব্যবসায় আস্থা বাড়ানোর জন্য সরকারকে খাতভিত্তিক গাইডলাইন তৈরি করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে মহামারীর প্রভাব থেকে বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ বিতরণের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে।

উল্লেখ্য, সানেম এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে ব্যবসায় আস্থা জরিপটি পরিচালনা করে আসছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/579647/