৩ মে ২০২১, সোমবার, ২:২৩

ভারতীয় ডাবল মিউটেশন করোনা বাংলাদেশে ঢুকলে সর্বনাশ

ইংরেজিতে একটি বাগধারা রয়েছে। সেটি হলো, To put all eggs in one basket. অর্থাৎ সমস্ত ডিম এক ঝুড়িতে রাখা। এর বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে এখন কম বেশি সকলেই ওয়াকেফহাল। সব কাজের জন্য এক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করা। অথবা কোনো জিনিস সংগ্রহের জন্য একটি মাত্র উৎসের ওপর নির্ভর করা। এই কাজটিই করেছে বাংলাদেশ সরকার। আর তার জন্য কি ভয়াবহ খেসারত দিতে হয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। এক মহা সংকট গ্রাস করছিল বাংলাদেশকে। সংকট কেটে গেছে, এখনও একথা বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশে রাশিয়া বা চীনের টিকা উৎপাদন করতে কত মাস লাগবে সে কথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। রাশিয়া নাকি ৪০ লাখ টিকা দেবে। সেই টিকার নাম ‘স্পুটনিক-ভি’। মে মাসের মধ্যেই কি স্পুটনিক-ভি’র পুরা চালান, অর্থাৎ ৪০ লাখ ডোজ আসবে? নাকি কিস্তি বন্দীতে আসবে? এখনও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। হতে পারে বলার সময় হয়নি। একই কথা চীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কবে তাদের টিকা বাংলাদেশে উৎপাদিত হবে? এখানে রাশিয়ার মতই সময় লাগতে পারে। চীন নাকি তাদের সিনোফার্মের ৬ লাখ টিকা উপহার হিসাবে দেবে। সেই ৬ লাখ ডোজ কবে আসবে? সেটাও এখনও পরিষ্কার নয়। হতে পারে, আগামী ২/৪ দিনের মধ্যেই সবকিছু পরিষ্কার হবে।

এসব কথা উঠছে এজন্যই যে অন্তত: ১৬ লাখ ভারতীয় টিকার জালে বন্দী হয়ে গেছে বাংলাদেশ। গত ২৬ এপ্রিল সোমবার থেকে সেরামের কোভিশিল্ড তথা এ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজের টিকা দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লক্ষ ১৮ হাজার ৪০০ জন। এই ৫৮ লক্ষ ১৮ হাজার ব্যক্তিকেই ঐ একই টিকা, অর্থাৎ কোভিশিল্ড বা এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয় ডোজে ঘাটতি আছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার জন। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত যত ব্যক্তি টিকা দিয়েছেন, অর্থাৎ সেরামের প্রথম ডোজ নিয়েছেন তাদের সকলকে দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে ঐ কোভিশিল্ডই নিতে হবে। কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ আর স্পুটনিক-ভি বা সিনোফার্মের দ্বিতীয় ডোজ- এই কম্বিনেশন চলবে না।

যখন স্পুটনিক বা সিনোফার্মের টিকা আসবে তখন ঐ একই কোম্পানীর প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। এই কোম্পানীর ফার্স্ট ডোজ, আর ঐ কোম্পানীর সেকেন্ড ডোজ চলবে না। তাহলে যারা সেরামের ফার্স্ট ডোজ নিয়ে বসে আছেন, তাদের কি হবে? কি হবে ঐ সাড়ে ১৬ লাখ মানুষের? তারা তো আধা খাঁচড়া হয়ে বসে আছেন। এখন উপায়? ঐ ১৬ লাখ সেরামের ডোজ আনতেই হবে। যে কোনো মূল্যে। আর সরকারকে বলি, আপনারা যখন দেখলেন যে সেরামের টিকা আসা অনিশ্চিত হয়ে গেছে তারপরেও আপনারা প্রথম ডোজ দেওয়া অব্যাহত রাখলেন কেন? কেন বন্ধ করলেন না? এখন ইন্ডিয়ার হাতে পায়ে ধরে ঐ ১৬ লাখ আনা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি?

॥ দুই ॥
এটা তো গেল স্বল্প মেয়াদী প্ল্যান। দীর্ঘ মেয়াদী প্ল্যান কি? ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৮৬ লক্ষ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে আর ১৬ কোটি যে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। এখনও ১ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যায়নি। বাকী ১২/১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেবেন কবে? কত বছরে? যে রেটে টিকা দিচ্ছেন এই রেটে দিলে কি কোনোদিন বাংলাদেশ থেকে করোনা যাবে?

দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়। সেটি হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে সময়ের ব্যবধান। প্রথমে বলা হয়েছিল যে প্রথম ডোজ ও দ্বিতীয় ডোজের ব্যবধান হবে এক মাস। আমি প্রথম টিকা নেই ১৫ ফেব্রুয়ারি। টিকা কার্ডে লেখা হয়, পরবর্তী ডোজ ১৬ মার্চ। অর্থাৎ একমাস। আমার কেন্দ্র ছিল পিজি হাসপাতাল। অর্থাৎ হোটেল শেরাটনের বিপরীতপাশে কনভেনশন সেন্টার। এর মধ্যে আমি ইন্টারনেটে দেশী এবং বিদেশী পত্রিকা পড়ি এবং একটি বিষয় জানতে পারি। জানতে পারি যে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের মধ্যবর্তী সময় এক মাস হলে পর্যাপ্ত পরিমাণ এবং যতখানি প্রয়োজন ততটুকু Immune System বা রোগ প্রতিরোধ শক্তি সৃষ্টি হয় না। সময়ের ব্যবধান যদি ৮ সপ্তাহ বা দুই মাস হয় তাহলে ভাল। আর যদি ১২ সপ্তাহ বা তিন মাস হয় তাহলে সবচেয়ে ভাল। আমি এই কথা সেখানকার উপ-পরিচালককে বলি। উপ-পরিচালক বলেন, তাঁর কিছু করার নাই। কারণ সরকারি সিদ্ধান্ত এক মাস।

তারপর কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় এবং ব্যবধান বাড়িয়ে দুই মাস করা হয়। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং থেকে জানা যায় যে ঐ দিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৬১৬ জন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২৮ লাখ ৫ হাজার ৬৯৪ জন। অর্থাৎ দুই ডোজ মিলিয়ে নিয়েছেন ৮৬ লাখ ২৫ হাজার ৩১০ জন। ক্রয় ও উপহার মিলিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে ১ কোটি ৩ লক্ষ ডোজ। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে ৮৬ লাখ ২৫ হাজার ৩১০ ডোজ। তাহলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে টিকা দেওয়া বাকী আছে ৩০ লাখ ১৩ হাজার ৯২২ জনের। সরকারের হাতে আছে (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) ১৩ লক্ষ ৭৪ হাজার ৬৯৩ ডোজ। তাহলে দ্বিতীয় ডোজ কমপ্লিট করতে হলে প্রয়োজন আরো ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ২২৯ ডোজের। এবং সেটা কোভিশিল্ড তথা এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা হতে হবে। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৭২ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫৬ জন।

॥ তিন ॥
এই ৭২ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫৬ জনকে না হয় রুশ স্পুটনিক অথবা চীনা সিনোফার্মের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হবে। অবশ্য এটি বলা হবে একটি হৃদয়হীন ব্যাপার। যেদিন এই লেখাটি বের হবে সেদিন, অর্থাৎ রোববার এই সংখ্যা বাড়তে পারে। রোববারের মধ্যে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ নিবন্ধন করতে পারেন। এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় থাকবেন। কারণ গত তিন মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে যারা টিকা নিয়েছেন এবং টিকা নেওয়ার পর ৮ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরও করোনা হয়েছে। কিন্তু এদের একজনও মারা যাননি। কিন্তু যারা এক ডোজও নেননি, তাদের মধ্যে যাদের করোনা হয়েছে তাদের মধ্যে থেকেই মৃত্যু ঘটছে। আমার তো মনে হয়, যতদিনে রুশ বা চীনা টিকা আসবে ততদিনে নতুন নিবন্ধনের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যারা কোভিশিল্ডের এক ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় অনিশ্চিত প্রহর গুনছেন তারা এবং যারা ইতোমধ্যেই নিবন্ধন করেছেন এবং ভবিষ্যতে নিবন্ধন করবেন, মানসিকভাবে সবচেয়ে বিপর্যস্ত তারা।

ইন্ডিয়ার এই চরম দুঃসময়েও কিন্তু আশার খবর রয়েছে। সেটি হল, সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকা উদারভাবে ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেরামের কোভিশিল্ডের টিকা উৎপাদনের জন্য যে কাঁচামালের প্রয়োজন সেটি আমেরিকা থেকে আসে। সেই কাঁচামাল রপ্তানির ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন সেরাম ফুল ক্যাপাসিটিতে উৎপাদনে যেতে পারবে। এছাড়াও আমেরিকা এবং বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গঠিত কোভ্যাক্স ভারতকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ৬ কোটি ডোজ এ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা সরবরাহ করবে। ভারতের এই স্টক থেকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ডোজ কমপ্লিট করার জন্য অন্তত: ১৬ লাখ টিকা চাওয়া যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল বলেছেন, ভারতের সাথে চুক্তি হয়েছে ৩ কোটি ডোজের। তারমধ্যে অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে দেড় কোটি ডোজের। তারা সরবরাহ করেছে ৭০ লাখ ডোজ। এখন ৮০ লাখ ডোজ পাওনা রয়েছে। এই ৮০ লাখ ডোজ থেকে অন্তত: ১৬ লাখ ডোজ চাওয়া যেতে পারে। যেহেতু তারা পশ্চিমা শিবির থেকে ৬ কোটি ডোজ পাচ্ছে তাই এই পাওনা ১৬ লাখ ডোজ চাওয়া অন্যায় বা অনৈতিক হবে না।

॥ চার ॥
এবার আসছি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায়।
করোনার যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন, সেটা ডাবল মিউটেশনের। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতে দৈনিক সংক্রমণের গড় সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। তিন মাস পর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সেটি হয়েছে গড়ে দৈনিক সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি। মৃত্যুও প্রায় ৪ হাজারের কাছে। বাংলাদেশেও, সরকারি তথ্য মোতাবেক, সংক্রমণ ৩০০ এরও নীচে নেমে এসছিল। সেটি আড়াই মাস পর ৭ হাজারের বেশি হয়েছিল। এখন ৪ হাজারের নীচে নেমে এসেছে (শুক্রবারের হিসাব)।

এমন একটি পটভূমিতে যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, বিশেষ করে ডাবল মিউটেশন ভ্যারিয়েন্ট, বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাহলে সর্বনাশ হবে। সেটি ঠেকাতে দুটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (দ্বিতীয় ডোজের কথা আগেই বলেছি। এখন ফার্স্ট ডোজের কথা বলছি।) লেখার এই পর্যায়ে জানা গেল যে চীনের সিনোফার্মের টিকা নাকি ১৫ দিনের মধ্যে আসছে। রাশিয়ার টিকাও যাতে ১৫ দিনের মধ্যে আসে সেজন্য জোর তদবির করতে হবে। জনগণ যাতে দলে দলে টিকা নিতে আসে, সে জন্য সারা দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

আর দ্বিতীয় কাজটি হলো ভারতে যাওয়া ও ভারত থেকে আসার সব পথ বন্ধ করা। স্থল পথ বন্ধ হয়েছে। বিমান ও নৌপথ বন্ধ হয়নি। ঈদের কেনা বেচার উছিলায় যেন এসব পথ খোলা না হয়। এটা কোনো ভারত বিরোধিতা নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর পথ। ভারত থেকে আসা প্রতিটি যাত্রীকে নিজ খরচে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে।

১৫ দিন পর নেগেটিভ টেস্ট রিপোর্ট পেলে ছেড়ে দেওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, একবার ভারতীয় ডাবল মিউটেশন করোনা ঢুকলে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবে।

Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/451494