১ মে ২০২১, শনিবার, ২:১২

ভয়ের কারণ রয়েছে ভারতের প্রতিবেশীদের

সাতজনের একজন দক্ষিণ এশিয়ার

করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ভারত। প্রতিদিনই দেশটি নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর দিক থেকে। নিয়মিত নতুন দৈনিক শনাক্তের বিশ্ব রেকর্ডও গড়ছে দেশটি। কিন্তু শুধু কি ভারত! করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যু উভয়ই বেড়ে চলেছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান ভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার বিশ্বের ২২২ দেশ এবং অঞ্চলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান সেই শুরু থেকেই বিরতিহীনভাবে নিয়মিত হালনাগাদ করে যাচ্ছে। এই ২২২ স্থানে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (শুক্রবার দুপুর) আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ কোটির বেশি মানুষ (১,৫১,১৬১,৯৪৭ জন)। বিপরীতে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার আট (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান) দেশেই আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ (২,০৮৫৪,৯৪৯ জন)। অর্থাৎ বিশ্বের মোট আক্রান্তের সাত ভাগের এক ভাগই দক্ষিণ এশিয়ার এই আট দেশের মানুষ! অথচ ঠিক আগের বছর (৩০শে এপ্রিল, ২০২০) বিশ্বজুড়ে মোট আক্রান্তের (৩,৪৭৭,৪৪৬) মধ্যে মাত্র ৬১,৯৯৮ জন ছিলেন এই আট দেশের।

অর্থাৎ ঠিক এক বছর আগে বিশ্বের মোট আক্রান্তের মাত্র ৫৬ ভাগের ১ ভাগ ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মানুষ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এই অঞ্চলে কতোটা জেঁকে বসেছে করোনা।

এছাড়া, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২২২ স্থানে মারা গেছেন প্রায় ৩২ লাখ মানুষ (৩১,৭৯,৯৬১ জন)। যাদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশেই মারা গেছেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ (২,৪৪,১৪০ জন)।

বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যাবিষয়ক কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার মানবজমিনকে বলেন, ‘চীনের উহান থেকে করোনার সংক্রমণ শুরুর দিকে পূর্ব-এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে করোনার লাগাম টেনে ধরে। পশ্চিমা দেশগুলো লকডাউন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায়। সেখানে যেসব মানুষ মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগই বয়স্ক এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু দু’- একটি ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুরু থেকেই করোনার ভয়াবহতাকে গুরুত্ব দেয়নি। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে শিক্ষা নেয়নি। জনগণের আস্থাও অর্জন করতে পারেনি।’

সম্প্রতি বিবিসি, সিএনএন সহ বহু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দক্ষিণ এশিয়ায় করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ভারতের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেই করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। বাংলাদেশ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা টিকাদান কর্মসূচি শুরু করলেও নামমাত্র একটি জনগোষ্ঠী টিকা গ্রহণ করতে পেরেছেন।

এই দেশগুলোতে সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষাপটে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো হলেও তা পর্যাপ্ত এবং যথাযথ নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়- গত বছরের জুনে বাংলাদেশ যখন সংক্রমণের চূড়ায় ছিল তখন বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৮ হাজারেরও বেশি টেস্ট করা হয়েছিল। সম্প্রতি সংক্রমণ বাড়ার কারণে এখন প্রতিদিন প্রায় ৩৫ হাজার টেস্ট করা হচ্ছে। তবে এখনো এই ব্যবস্থার টেস্টে প্রতি পাঁচটি টেস্টের বিপরীতে মাত্র একজন শনাক্ত হচ্ছেন- ডব্লিউএইচও (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) অনুযায়ী শনাক্তের এই সংখ্যা প্রকৃত সংক্রমণ সংখ্যার কেবল একটি সামান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে।

টেস্ট সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে ভাইরোলজিস্ট ড. শহীদ জামিল বিবিসিকে বলেন ‘যেমন খুশি তেমন করে নয়, টেস্ট পজিটিভিটি হারের ভিত্তিতে টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’ বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়- র?্যাপিড টেস্ট এ অঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও এটা অন্যান্য ধরনের টেস্টের মতো সংক্রমণ শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য নয় বলে অনেকেই উদ্বিগ্ন।

অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ভ্যাকসিন গ্রহণের ব্যাপারে জনগণ সেভাবে আগ্রহী না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন ড. জিয়া। তিনি বলেন, ‘শুরু’ থেকেই সরকারগুলো ভ্যাকসিন পেতে বিশ্বজুড়ে বিকল্প উৎসের দিকে নজর না দিয়ে নির্দিষ্ট উৎসের উপর নির্ভর করেছিল।

এদিকে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা যাই হোক, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত শনাক্তের সংখ্যাও গত বছরের তুলনায় এ বছর যে হারে বেড়েছে তা দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য।

ওয়ার্ল্ডোমিটার এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারা বিশ্বে সংক্রমণের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারতে গত বছর ৩০শে এপ্রিল শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৩৪,৮৬৩, যা এ বছরের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫৬,৯৫৫তে! ৩১তম স্থানে থাকা পাকিস্তানে গত বছর ৩০শে এপ্রিল শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৬,৪৭৩, যা এ বছরের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮,২০,৮২৩তে! ৩৩তম স্থানে থাকা বাংলাদেশে শণাক্তের সংখ্যা ছিল ৭৬৬৭ যা এখন ৭,৫৬,৯৫৫! ৫৩তম স্থানে থাকা নেপালে গত বছর ছিল মাত্র ৫৮ যা এখন ৩,১৭,৫৩০! ৮৯তম স্থানে থাকা শ্রীলঙ্কায় ছিল মাত্র ৬৫০ যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০৬৪৮৪তে! ১০৫তম স্থানে থাকা আফগানিস্তানে গত বছর ৩০শে এপ্রিল শনাক্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ২,০০০ যা এ বছরের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯,৭৪৫তে! ১২০তম স্থানে থাকা মালদ্বীপে ছিল মাত্র ২৮০ যা এখন ২৯,৩৭০! দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা (বিশ্বে সংক্রমণ সংখ্যায় ১৯৩তম) ভুটানে গত বছর ছিল মাত্র ৭ যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০৬৬তে!
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভারতে মারা গেছেন ২০৮৩৩০ জন, পাকিস্তানে ১৭৮১১ জন, বাংলাদেশে ১১৩৯৩ জন, নেপালে ৩২৪৬ জন। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটানে যথাক্রমে ২৬২৫ জন, ৬৬১ জন, ৭৩জন এবং ১ জন মারা গেছেন।

এসব পরিসংখ্যান বাদ দিলেও ঠিক এই মুহূর্তে ভারতের মতো বৃহৎ এবং জনবহুল প্রতিবেশী দেশে করোনার ভয়াবহ চিত্র থেকে যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে দ্রুত শিক্ষা নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারোরই। সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে যেমন বলা হয়েছে- ভারতের মৃত্যুদৃশ্য দেখে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভয় পাওয়ার এবং সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=272409&cat=2