৩০ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৫:১৪

ঈদ ঘিরেই ক্ষতি এক লাখ কোটি টাকা

দেশজুড়ে বন্ধ দোকানপাট শপিংমলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চলমান সাধারণ ছুটির সঙ্গে বন্ধ রয়েছে সবধরনের দোকানপাট, শপিংমলসহ প্রায় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। বিপাকে পড়েছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরাও। শুধু ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ বেচাকেনা হয় তার পরিমাণ অন্তত এক লাখ কোটি টাকা থেকে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে এর প্রায় পুরোটাই ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে ঈদকে ঘিরে যে ধরনের কেনাকাটা হয় তা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। রোজার মাঝামাঝিতে পরিস্থিতির উন্নতি হলে দোকানপাটসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারে সরকার। কিন্তু তারপরও সেটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না। কেননা সবধরনের কাজকর্ম বন্ধ থাকায় মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ থেমে গেছে। ফলে করোনা-পরবর্তী সময় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট খুলে দিলেও লোকসান পুষাতে সরকারের নীতিগত ও আর্থিক সহায়তার কোনো বিকল্প নেই বলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ঘটনা-১ : খিলগাঁওয়ের তালতলা সিটি করপোরেশন মার্কেটের একটি দোকানে কাজ করতেন ২৫ বছর বয়সী যুবক রাসেল। বেতন পেতেন ১২ হাজার টাকা। বর্তমানে মার্কেট বন্ধ থাকায় রাসেলেরও কাজ নেই। গত মাসের বেতনও পাননি। চলতি মাসের বেতনও দেওয়া হবে না বলে মালিক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছেন রাসেল। করোনার প্রভাব কেটে গেলে চাকরি ফিরে পাবেন কিনা-তা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন রাসেল।

ঘটনা-২ : পল্টন মোড়ে ফুটপাথের ওপর চশমার দোকান করতেন বরিশালের যুবক শরীফ। করোনায় অচল পরিস্থিতির কারণে প্রায় দুই মাস ধরে তার দোকান বন্ধ। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে রোজগারও। একটি সমবায় সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। তার কিস্তি অবশ্য স্থগিত রয়েছে। কিন্তু দোকানপাট খুললেই কিস্তিও শুরু হবে। বর্তমানে পল্টন এলাকায় ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছেন। গতকাল মোবাইল ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। জানান, গত প্রায় এক মাস শুধু চাল, ডাল, তেল, লবণ বাদে কোনো সবজি কিংবা মাছ-মাংস কিনতে পারেননি। এমন কি ডিমও নয়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, এ খাতে অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ কর্র্মী রয়েছেন। এদের সবাই এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। স্বল্প পরিসরে যেসব মুুদি দোকান বা শাক-সবজির দোকান খোলা রয়েছে তারাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। লোকসানের মুখে পড়ায় এসব দোকান-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা কর্মীদের বেতন দিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। কর্মীদের বেতন-ভাতা দিয়ে করোনা-পরবর্তী ব্যবসা সচল রাখতে সরকারের কাছে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার তহবিল সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। যা তারা ঋণ হিসেবেই চান। সংগঠনের সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৫ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে অন্তত এক থেকে দেড় লাখ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়ে থাকে। এরপর এ নিয়ে আর কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে গত ৫ বছরে এর পরিমাণ আরও বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু এবার তার পুরোটাই ক্ষতি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের সহায়তার কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ছোট ব্যবসায়ীদের কেউই ঋণ দিতে চায় না। এ জন্য এ বিপর্যয়ের মুহূর্তে বিপুলসংখ্যক এই জনগোষ্ঠীকে বাঁচাতে সরকারের কাছে সহায়তা তহবিল চেয়েছেন তিনি। জানা গেছে, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শপিংমল, বিভাগীয় ও জেলা শহরের শপিংমল, এমনকি বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথসহ সবধরনের কেনাকাটা জমজমাট থাকে। এ সময় প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে থাকা প্রিয়জনদের জন্য বেশি করে টাকা পাঠান। যা রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ে। এবার করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রবাসীদের অনেকে আগেই ফিরে এসেছেন জীবন বাঁচাতে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিতেও ভয়াবহ ধস নেমেছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রভাব নেতিবাচক পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঈদ উপলক্ষে অর্থের বড় একটা জোগান আসে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, গতিশীলতা পায় অভ্যন্তরীণ বাজার, জাকাত ও ফিতরায় প্রচুর অর্থের বিনিময় হয়। এ বছর সরকারি বাদে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীরা ঈদের আগে ঠিকমতো বেতন পাবেন কিনা-তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরাও বিপাকে পড়েছেন। তারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো লড়াই করছেন। এফবিসিসিআই, দোকান মালিক সমিতির তথ্য হচ্ছে, প্রতি ঈদ বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ পোশাক, ২০ শতাংশ খাদ্যদ্রব্য এবং বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য পণ্য বা সেবা বিক্রি থেকে আসে। এর একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে পর্যটন। কেননা ঈদের সময় মানুষ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়। আবার প্রচুরসংখ্যক মানুষ গ্রামে গিয়ে ঈদ করে। এতে প্রান্তিক পর্যায়েও টাকার সরবরাহ বাড়ে। যার প্রায় সবই এবার বন্ধ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চিরায়ত এ উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকা যেমন বাড়ে তেমনি চাঙ্গা হয়ে উঠবে গোটা দেশের অর্থনীতি। তাদের মতে, ভোগ-বিলাস খাতেই বেশির ভাগ টাকা খরচ হয় ঈদ মৌসুমে। কিন্তু এ বছর মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগের মাত্রা প্রায় তলানিতে নেমে গেছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঈদ উৎসব ঘিরে বাড়তি টাকার প্রবাহে সচল হয়ে ওঠে গ্র্রামের অর্থনীতি। এ সময় নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও টাকা যায়। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু এ বছর এর সবই বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে সার্বিক অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে এই ক্ষতির মাত্রা কতটা ভয়াবহ হবে তা হয়তো এখনই নিরূপণ করা যাবে না। তবে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তা হয়তো সবাই অনুমান করতে পারছেন। জানা গেছে, ঈদ উৎসবের কেনাকাটায় শুধু বস্ত্র কিংবা জুতা নয়, ভোগ্যপণ্য, ইলেকট্রনিক পণ্য, ভ্রমণ, পবিত্র ওমরাহ পালন, ফার্নিচার, গাড়ি ও আবাসন খাতসহ প্রতিটি সেক্টরে নগদ টাকার লেনদেন হয়। এর বাইরে সমাজের বিত্তবানদের জাকাত, ফিতরা দেওয়ায় ধনী-গরিব সবার হাতে টাকার প্রবাহ বাড়ে। উৎসব ঘিরে যেমন ব্যয় হয়, তেমন জোগানও আসে বিভিন্ন খাত থেকে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে এবার সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, দেশব্যাপী প্রায় ৫৪ লাখ দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে অন্তত ২৫ লাখ রয়েছে দোকান। যেগুলো সরাসরি কোনো না কোনো পণ্য কিংবা সেবা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়। এরমধ্যে স্বল্প পরিসরে জরুরি খাদ্যপণ্য আর ওষুধের দোকান বাদে সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। খাদ্যপণ্যের দোকান খোলা থাকলেও মানুষের ভোগের মানসিকতা কমে গেছে। আবার খুব জরুরি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ছাড়া অন্যান্য খাদ্যপণ্যের উৎপাদনও বন্ধ রয়েছে। এর ফলে কমপক্ষে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা কম লেনদেন হবে এবারের ঈদে।

https://www.bd-pratidin.com/first-page/2020/04/28/525019