৩০ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৫:১৩

নগর দরিদ্ররা যাবে কই

করোনাভাইরাসের প্রকোপে শহরের দরিদ্রদের সমস্যা বেড়েই চলেছে। লকডাউনের ফলে কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ নেই অনেকের। হাজার হাজার দিনমজুরের আয় ব্যাপক হারে কমেছে। অনেকের আয় নেমেছে শূন্যের কোটায়। দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল এসব পরিবার দিনের খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। তারা বলছেন, কাজ অথবা সরকারি সহায়তা ছাড়া তাদের বেঁচে থাকার উপায় নেই।

অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে নামলেও সরকারি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ এসব পরিবারের কম বা নেই বললেই চলে। কারণ, সরকারি সহায়তা পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই নেই শহরের সিংহভাগ দরিদ্র পরিবার। শহরের দরিদ্রদের অধিকাংশই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কোনো তালিকাতেই অন্তর্ভুক্ত নন। শহরে বাস করলেও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না থাকায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব দরিদ্র পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা হয় না। আবার গ্রামে স্থায়ী বসবাস না করার ফলে সেখানেও তালিকাভুক্ত হতে পারেন না। দারিদ্র্য, নদীভাঙন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার পরিবার গ্রাম থেকে শহরে এসে জীবনযাপন করছে। শহরে এসে এসব পরিবার বস্তিতে বসবাস করে। দিনমজুর, হকারি, ছোট ব্যবসা তাদের আয়ের উৎস। লকডাউনের কারণে এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ কমেছে, আয় কমেছে। ফলে তারা খাবারও কম খাচ্ছে। অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে অথবা অন্য শহরে চলে গেছেন। বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের পরিবারকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দ্রুত খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, শহরের লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ রয়েছে যাদের খাদ্য নিরাপত্তা নেই। এসব মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাও পাচ্ছেন না। শহরের দরিদ্রদের মাত্র এক শতাংশ টিসিবি বা ওএমএসের পণ্য কেনেন। বয়স্কভাতা পান মাত্র দুই শতাংশ। এছাড়া শহরের দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষেরা সরকারি কোনো সহায়তা পান না। এখন টিসিবি এবং ওএমএসের পণ্য কেনার মতো অর্থও এখন তাদের হাতে নেই।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব পরিবারকে সহযোগিতা জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারকে সরকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে একটি জরুরি নম্বর চালু করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, একটি নম্বর থাকবে, যেখানে মানুষ নিজে এসএমএস করে বা ফোন করে জানাতে পারবেন তিনি অর্থ কষ্টে পড়েছেন। নিজেই নিজের তথ্য দিতে পারবেন। কোথায় বাস করেন, কী কাজ করতেন, এখন কী করছেন, পরিবারের সদস্য কতজন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্য। সরকার সেটা যাচাই করে সহযোগিতা করবে। কেউ মিথ্যা তথ্য দিলে শাস্তির ব্যবস্থাও রাখতে হবে।

বিবিএসের সর্বশেষ জরিপের তথ্যের প্রাক্কলন থেকে ২০১৯ সালে সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। সে অনুযায়ী দেশে সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এক জরিপ শেষে প্রাক্কলন করেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে নতুন করে দেশের আড়াই কোটি মানুষের জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ফলে সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এই দরিদ্রদের প্রায় অর্ধেকই শহরে বসবাস করে বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা সমকালকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যে কাঠামো তাতে কয়েকটি কর্মসূচি ছাড়া বাকি সব গ্রামকেন্দ্রিক। ফলে শহরের দরিদ্ররা অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে রয়েছে। বর্তমানে করোনার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু শহরের জন্য আলাদা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। অথবা গ্রামে চালু আছে যেসব কর্মসূচি সেগুলো শহরে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে যেটাই করা হোক দ্রুত করা দরকার।

বিবিএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপ্রত্যাশিতভাবে আর্থিক সংকটে পড়লে ৩৯ শতাংশ মানুষ খাবার বাবদ ব্যয় কমিয়ে তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। সংকটে পড়লে ২২ শতাংশ পরিবার কম খাবার খায়, আবার ১৭ শতাংশ পরিবার নিম্নমানের খাবার খায়।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নগর অঞ্চলে খাবার নেই, আবার খাবার কেনার টাকাও নেই এমন মানুষের হার ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। আবার এক বেলা খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায় ৮ দশমিক ২২ শতাংশ মানুষ।

বিবিএস বলছে, দুর্যোগে ২০ শতাংশের বেশি পরিবার তেমন কিছুই করে না। তা ছাড়া সঞ্চয় ভেঙে, ঋণ করে বা অন্যদের সহায়তা নিয়ে অনেকে সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে বছরের বেশি সময় ধরে চলমান সংকটে অনেকেরই সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। ঋণের পরিমাণও উন্নীত হয়েছে দ্বিগুণে। সরকারি-বেসরকারি সহায়তাও কমে আসছে। এর ফলে খাবারে কাটছাঁট করা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

অঞ্চল ও পেশার বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা ১০ শ্রেণির মানুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, প্রায় ৮১ শতাংশ পরিবার করোনার কারণে খাদ্য-ব্যয় কমিয়েছে। আয় কমে যাওয়ায় বস্তিবাসী খাবার কেনায় এখন ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ কম ব্যয় করে। দুই শতাংশের বেশি মানুষ মাসে অন্তত একদিন একবেলাও খাবার পায় না। করোনায় আয় হারিয়ে পুষ্টিকর খাবারের জোগান নিয়ে দুর্ভাবনায় এখন লাখ লাখ মানুষ।

খাবারের বৈচিত্র্য ও পরিমাণ কমে আসায় পুষ্টি পরিস্থিতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, দীর্ঘ দিন কম খেয়ে থাকার কারণে অপুষ্টির শিকার লোকজন আর আগের মতো কাজ করার শক্তি পাবে না। এর ফলে করোনার প্রকোপ কমে এলেও জাতীয় উৎপাদনশীলতা আগের অবস্থায় ফিরবে না। পুষ্টির অভাবে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে এর প্রভাব আগামী প্রজন্মেও পৌঁছাবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/210460495/