৩০ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৫:১১

শিক্ষাখাতে বিপর্যয়

ঈদের পরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা অনিশ্চিত

প্রায় ১৩ মাস পড়াশোনার বাইরে ৩ কোটির বেশি শিক্ষার্থী

প্রাণঘাতি মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে শিক্ষাখাতে। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতির কারণে গতবছরের ক্লাসের পাশাপাশি সাময়িক, বার্ষিক পরীক্ষা, প্রাথমিক-ইবতেদায়ী সমাপনী, জেএসসি-জেডিসি, এইচএসসি-আলিম পরীক্ষার কোনটিই নিতে পারেনি সরকার। উচ্চমাধ্যমিকসহ সবকটি শ্রেণিতেই দেয়া হয়েছে অটোপাস। একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র সেশনজট। আবার যারা চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাদের কেউ কেউ অনার্স শেষ না হওয়ায়, অনেকে একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরির প্রত্যাশায় থেকে হতাশ হয়ে পড়ছেন। বন্ধের মধ্যে অনলাইনে পাঠদানের কথা বলা হলেও তা নাম মাত্র। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে অনলাইন ক্লাস ও পাঠদানের সংশ্লিষ্টতাও নেই। ফলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্কুল-ক্লাস-পাঠ্য বইয়ের কথা ভুলতে বসেছে শিক্ষার্থীরা।

জানা যায়, দেশে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী রয়েছে এক কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ১০০ জন। আর মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন। এ ছাড়া প্রাক-প্রাথমিক ও ইবতেদায়িতে আরো প্রায় ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ কোটির ওপরে।
অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে ৮ লাখের মতো শিক্ষার্থী। প্রায় ১৩ মাস ধরেই এসব শিক্ষার্থী আছেন পড়াশোনার বাইরে। যদিও চলতি বছরের শুরুর দিকে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় গত ৩০ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষামন্ত্রণালয়। কিন্তু আবারও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আগামী ২৩ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে ২৩ মে পর্যন্ত স্কুল-কলেজ এবং ২৪ মে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

এপ্রিল মাসজুড়ে করোনার শনাক্ত ও মৃত্যুর হার ফেব্রæয়ারি-মার্চের তুলনায় বেশি হওয়ায় ঈদের পরে ২৩ থেকে ২৪ মে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেবে কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এতে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের অপেক্ষা আরও বাড়তে পারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত পূর্ব নির্ধারিত তারিখেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত রয়েছে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর। সার্বিক পরিবেশ বিবেচনা করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

গত এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন চলতি বছরের এসএসসি-দাখিল ও এইচএসসি-আলিম পরীক্ষার্থীরা। রুটিন অনুযায়ী গত ফেব্রæয়ারিতে এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষা এবং এই এপ্রিলে এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই শিক্ষার্থীদের এখনো প্রয়োজনীয় পড়ালেখাই শেষ হয়নি। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬ মাসের মতো ক্লাস করেছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা, এসএসসি পরীক্ষার্থীরাও পেয়েছেন একবছরের মতো সময়। গত এক বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করে শিক্ষাবোর্ডগুলো। এই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ক্লাসে পড়িয়ে পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা করছে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

এসএসসি-দাখিল পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নেহাল আহমেদ বলেন, পরীক্ষা নেয়ার জন্য আমাদের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হলেই আমরা নিতে প্রস্তুত। শিক্ষার্থীরা প্রস্তুত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘ এক বছর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। যদিও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে তারপরও তাদের কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর এসএসসির জন্য ৬০ কর্মদিবস ক্লাস, এইচএসসির জন্য ৮৪ কর্ম দিবস ক্লাস করিয়ে এর ১৫ দিন পর পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। এজন্য ইতোমধ্যে আমরা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস দিয়েছি। এর বাইরে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত হয়নি।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী ২৩ মে থেকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত আমাদের পূর্বের সিদ্ধান্তই বহাল রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে মোতাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সচিব বলেন, করোনার মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে আমরা টেলিভিশন, অনলাইন ও রেডিওতে ক্লাস স¤প্রচার শুরু করেছি। তার পাশাপাশি মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বাসায় অ্যাসাইনমেন্টের কাজ দেয়া হচ্ছে।
শিক্ষা সচিব বলেন, দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগামী ২৩ মে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হবে। আমাদের আগের ঘোষণা অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত ছিল তা এখনো বহাল রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

অনলাইন ক্লাসে নেই গ্রামের শিক্ষার্থীরা : গত বছরের ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার শুরু হয়। শহরের নামি-দামি কিছু স্কুল অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে, তবে মফস্বল ও শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এখনো পড়ালেখার বাইরে রয়েছে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দূরশিক্ষণে (সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল ফোন) ৩১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো ধরনের অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসেনি। যেসব শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছে তাদের মধ্যে ৫৭.৯ শতাংশ ডিভাইসের অভাবে অংশ নিতে পারছে না। আর গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৬৮.৯ শতাংশ।

রাজধানী ও জেলা সদরের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখছে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ৪০ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের যুক্ত হতে হতেই অনেকটা সময় চলে যায়। এরপর রোল নাম্বার ডাকা ও পড়া শুরু করতে করতেই সময় শেষ হয়ে যায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনলাইনে নামে মাত্র পড়ালেখা হচ্ছে। অনেক স্কুল অনলাইনে পরীক্ষাও নিচ্ছে। তবে সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার আগে খুবই সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন বা হুবহু প্রশ্নই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর প্রশ্নগুলোও দেওয়া হচ্ছে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, এককথায় উত্তর বা শূন্যস্থান পূরণ ধরনের। ফলে শিক্ষার্থীরাও পুরো বই পড়ছে না। এতে তারা প্রয়োজনীয় শিখনফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবনে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে যেসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন তারা প্রায় দুই বছরেও এখনো একই বর্ষে রয়েছেন। একই অবস্থা অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও। গতবছর করোনা শুরুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে ক্লাস শুরুর চেষ্টা করা হলেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ডিভাইস সঙ্কট ও ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে সেই উদ্যোগ।

এদিকে করোনার কারণে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে সেই একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরুর চিন্তা করছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করে জুলাই মাসে পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন একই পথে হাঁটতে পারে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা পিছিয়ে দিচ্ছে সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভবনা খুব ক্ষীণই মনে করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নেহাল আহমেদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির বিষয়ে তো আগে থেকে কিছু বলা যাচ্ছে না। এখনো যেহেতু সময় আছে তাই তাই খোলার ব্যাপারে আশা করতেই পারি। পরবর্তীতে সরকারের উচ্চ পর্যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

মে-জুনের ‘ও’ লেভেল-‘এ’ লেভেল পরীক্ষা বাতিল : করোনার কারণে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরের ‘ও’ লেভেল এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। আগামী মে-জুনে সামার সেশনের এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাজ্য (ইউকে) সরকার নিজ দেশের পরীক্ষা বাতিলের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত ব্রিটিশ কারিকুলামের উল্লিখিত সেশনের পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে। তবে অক্টোবর-নভেম্বরে নির্ধারিত পরীক্ষাটি হবে। কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে চাইলে তখন অংশ নিতে পারবে।

এর আগে করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছরের সামার সেশনের পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছিল। তবে অক্টোবর নভেম্বর সেশনের পরীক্ষাটি নেওয়া হয়েছিল।

সামার সেশনের পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে পিয়ারসন-এডেক্সেলের বাংলাদেশ প্রধান আবদুল্লাহ লিটন বলেন, ব্রিটেনে শিক্ষা পরিচালনা করে যেসব শিক্ষা বোর্ড সেগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার নাম ‘অফকল’ (ওএফকিউইউএএল)। এই সংস্থা শুধু মে-জুনে পরীক্ষা না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যেহেতু যুক্তরাজ্যে আসন্ন সামার সেশনে (মে-জুন) কোনো পরীক্ষা নিচ্ছে না সরকার, তাই এই বোর্ডের অধীন বিশ্বের কোনো দেশেই ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পর্যায়ের পরীক্ষা হচ্ছে না। তবে কেউ চাইলে অক্টোবর-নভেম্বরে নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। সেই পরীক্ষাটি নেওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত আছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/378070/