৩০ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৫:১০

ভারত থেকে নিতে হবে ৭৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা

লেজেগোবরে অবস্থায় সৌর পার্ক বাগেরহাট থেকে জামালপুরে

সোলার পার্ক হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনুমোদনের পর অদূরদর্শিতায় ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন লেজেগোবরে অবস্থা করে এখন বাগেরহাট থেকে জামালপুরে করা হচ্ছে। অনুমোদনের তিন বছর পর প্রকল্পটির স্থান পরিবর্তন করা হলো। ভারতীয় তৃতীয় এলওসিতে জামালপুরের মাদারগঞ্জে ৩২৫.৬৫ একর জমিতে নির্মিত হবে দেশের সবচেয় বড় সোলার পার্ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে এই পার্কের নামকরণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন খরচ এক হাজার ৪৯৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ভারতীয় নমনীয় ঋণের শর্ত অনুসারে প্রকল্প সহায়তার আওতায় প্রয়োজনীয় মালামাল ও সেবার ৭৫ শতাংশ ভারত থেকে সংগ্রহ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলে প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে। প্রকল্প পরিচালক মো: আবদুস সুবর বলেন, অনুমোদন পেলেই আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারব।

বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ অনুসারে জ্বালানি বহুমুখীকরণের জন্য আগামী ২০২০ সাল নাগাদ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ২৩ শ’ মেগাওয়াট হবে নবায়নযোগ্য। এর অংশ হিসেবে বাগেরহাটের মোল্লাহাটে নির্মাণ করা হচ্ছে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৫০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৮ সালে। অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৮২ কোটি ৭০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিওবি ৭৯ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। গত ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়ে মূল প্রকল্প শুরু করার কথা; কিন্তু সেটি আলোর মুখ দেখেনি। মূল প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৩৪১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের তহবিল থেকে ১৯৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা, ভারতীয় ঋণ (এলওসি) থেকে এক হাজার ১৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) নিজস্ব তহবিল থেকে আট কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।

জানা গেছে, সম্প্রতি এই প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে পর্যালোচনা সভা হয়। তাতে জানানো হয়, ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। তাদের সাথে গত ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল চুক্তি হয়। তাদের মাধ্যমেই মোল্লাহাটে ৫০০ একর অ-ফসলি বিরানভূমিকে প্রকল্পের সাইট হিসেবে চিহ্নিহ্নত করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইসহ পরিবেশগত যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন করে। প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সম্মতি রয়েছে প্রকল্পটিতে। মূল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ঋণচুক্তি হয় গত ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর। ইতোমধ্যে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কাছে ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, জামালপুরে যমুনা নদীর পাড়ে দেশের ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এক হাজার ১১২ কোটি টাকা ঋণ দেবে ভারত। বাগেরহাটে নির্মাণ করার সময়ই যার চুক্তি হয়েছিল। ৩২৫ দশমিক ৬৫৩৬ একর জমির ওপর ২০ বছর মেয়াদি এই সোলার প্ল্যান্ট নির্মিত হবে।

আরপিসিএল সূত্র জানায়, ভূমি জটিলতাসহ নানা কারণে বাগেরহাট জেলার মোল্লøাহাটে ১০০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজটি অনুমোদন পেয়েও হয়নি। প্রকল্প এলাকায় জলাশয় থাকায় তা ভরাট করা হলে পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে জলাশয় ভরাট না করে ফিশারিজসহ অনান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। একটি বিস্তারিত স্টাডির ভিত্তিতে সোলার প্যানেল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন প্রকল্প নতুনভাবে ডিজাইন করার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। একনেক সভার নির্দেশনা অনুসারে বাগেরহাটে প্রকল্প এলাকার জলাশয়ে ফিশারিজসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের সুবিধা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে এ দু’টি পদ্ধতিতে মোল্লাহাট প্ল্যান্ট স্থাপনের উপযোগিতা নেই। ফলে ২০১৪ সালে বিদ্যুৎ বিভাগে অনুষ্ঠিত প্রকল্প যাচাই কমিটির সভায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মোল্লাহাটের পরিবর্তে জামালপুরের মাদারগঞ্জে নির্মাণের সুপারিশ করা হয়।

ওই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মান প্রতিষ্ঠান এফজি অ্যান্ড কোং কেজি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে কাজ দেয়া হয়। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় ৫০০ একর জমিতে ৮৭.৫৫ মেগাওয়াট পিক ক্ষমতার বেশি সোলার পিডি পাওয়ার প্ল্যান্ট (মৎস্য চাষসহ) স্থাপন করা সম্ভব নয়। আর প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৫১৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং বিদ্যুতের মূল্য হার ১৯ টাকা ৫১ পয়সা অত্যধিক।

আরপিসিএল সূত্রে জানা গেছে, তারা এই প্রকল্পের জন্য মাদারগঞ্জ উপজেলার জোড়াখালী ইউনিয়নের কাইজারচর মৌজায় যমুনা নদীর নিকটবর্তী এলাকায় সরকারি খাস জমি নির্বাচন করেছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ২০২০ সালে ৩২৫ দশমিক ৬৫ একর জমির দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যমুনা নদী প্রকল্প এলাকা থেকে ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফলে এলাকার ভূমি তুলনামূলক স্থিতিশীল। এ ছাড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ওই এলাকায় বন্যা ও নদীভাঙনের ঝুঁকি কম। এ কারণে প্রকল্পের জন্য নদীর পাড়ে কোনো বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজন হবে না। সৌর প্যানেলগুলো সুরক্ষার জন্য প্রকল্প এলাকার চার পাশে সাড়ে ৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রকল্প এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ মিটার উঁচু হলেও বন্যা থেকে রক্ষার জন্য ভূমি উন্নয়ন করে অতিরিক্ত ২ মিটার উচ্চতায় (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ মিটার) লেভেলিং করা হবে।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আবদুস সবুরের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, মাটি সমস্যার কারণে মোল্লাহাটে প্রকল্পটি করা যায়নি। আর সেখানে কষ্টও বেশি হতো। তবে এখানে অনেক ভালো হবে। খোলা জায়গার কারণে ভবিষ্যতে আমরা বিকল্প কোনো চিন্তাও করতে পারব। আর এখানে যৌথভাবে অন্য একটি প্ল্যান্টও হচ্ছে। তিনি বলেন, আশা করছি একনেক অনুমোদন পেলেই আমরা দ্রুত কাজ শুরু করতে পারব। পিইসি, পরিকল্পনামন্ত্রীর স্বাক্ষরসহ সবই হয়ে আছে। আশা করছি, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে ময়মনসিংহ, জামালপুর ছাড়াও আমরা ঢাকাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারব।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/579108