৩০ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৫:০৬

সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন

প্রতি বছর ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি কলকাতায় ভালো ছিলেন না, তাই তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। বাংলাদেশ সরকার তার থাকার জন্য সব ব্যবস্থাই করে। ঢাকায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয় তারই ইচ্ছানুসারে। প্রতি বছর তার জন্মবার্ষিকীতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী পৃথক বাণী প্রদান করেন।

কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে একটি সত্য আমাদের মানা উচিত যে, তাদের বিচার করতে হবে প্রধানত তাদের সাহিত্যকর্ম দ্বারা। তাদের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে বিচার করা ঠিক নয় এবং তাদের মহান সাহিত্যকর্মকে খাটো করাও সঙ্গত নয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, যখন ফররুখ আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, আল্লামা ইকবাল এবং রবীন্দ্রনাথের কথা আসে, তখনই কিছু লোকের কাছে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রবল হয়ে ওঠে। যেমন- কবি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তার বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা, শিবাজীকে জাতীয় বীর মনে করা এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিরোধিতা এসবকেই প্রধান মনে করা হয় এবং তার সাহিত্যকর্মকে প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয় না। এটা নিঃসন্দেহ যে, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে হিন্দু দর্শনে বিশ^াস করতেন। তিনি বেদ, উপনিষদের কথাই প্রচার করেছেন। কিন্তু এর পরও তার সাহিত্যকর্ম বিশ^ব্যাপী স্বীকৃত এবং সেভাবেই তাকে বিচার করা উচিত।

তেমনিভাবে ইকবাল আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। সেটাই তার ক্ষেত্রে বড় করে দেখা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ফার্সি-উর্দু সাহিত্যের একজন মহাকবি; সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। তিনি কোনো গোত্র, ধর্ম বা এলাকার বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি প্রধানত নিজের জাতির কথা বলেছেন।

একইভাবে কবি ফররুখ আহমদের কথা এলেই তার রাজনৈতিক মতামতই বড় করে দেখা হয়। তার সাহিত্যকর্মকে কিছু লোক গুরুত্ব দেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি ইসলামের বাণী তার কবিতায় তুলে ধরেছেন। কোনোভাবেই তিনি কোনো ধর্ম বা জাতির বিরুদ্ধে ছিলেন না।

কাজী নজরুল ইসলাম একজন বিশ^মানের কবি ছিলেন। বাংলা কিংবা অন্য যেকোনো ভাষায় তার মানের খুব স্বল্পসংখ্যক কবিই রয়েছেন। তার কবিতা ও গান বহুমুখী। স্বাধীনতার চেতনা উজ্জীবিত করার জন্য তিনি রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তার কবিতা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা জোগায়। শুধু তা-ই নয়, তার গান ও কবিতা সব সময় যেকোনো স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তিনি বহু ইসলামী গান ও কবিতা লিখেছেন। তার কবিতায় তিনি কুরআনের অংশবিশেষ অনুবাদ করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া তিনি হিন্দু জনগোষ্ঠী, গরিব এবং বঞ্চিতদের জন্যও কবিতা লিখেছেন।

আমরা লক্ষ্য করেছি, তাকে ‘অসাম্প্রদায়িক’ কবি প্রমাণ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়। নজরুল ইসলাম অবশ্যই সব মানুষের অধিকার চাইতেন; গরিবের, নারীর, অন্য সবার। কিন্তু তিনি অসংখ্য ইসলামী গান ও কবিতা রচনা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী লেখা এবং আমপারার কাব্যে অনুবাদকে সাম্প্রদায়িক কাজ মনে করেননি। নিজের সম্প্রদায়ের জন্য, নিজের জাতির জন্য লেখা অন্যায় এবং সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। নজরুল-সাহিত্যের মৌলিক ইসলামী চরিত্রকে অস্বীকার করা ইসলাম বিদ্বেষেরই পরিচায়ক। সমাজ যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং সেই সমাজ ও রাষ্ট্র যদি ইসলামের ভিত্তিতে চলে এবং অমুসলিমদের পূর্ণ অধিকার বহাল রাখা হয়, তাহলে তা সাম্প্রদায়িকতা নয়। একইভাবে যদি কোনো সমাজ খ্রিষ্টান বা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং সে সমাজ ও রাষ্ট্র ওই ধরনের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়, তা সাম্প্রদায়িক হবে না, যদি মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মানবাধিকার বহাল থাকে।

কবি নজরুল ইসলামের সঠিক মূল্যায়ন যে বাংলাদেশে হচ্ছে, তা বলা যায় না। আমরা যতটুকু জানি, বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা সাহিত্য কোর্সে নজরুলের যথাযোগ্য মূল্যায়ন হচ্ছে না। আশু এর অবসান হওয়া দরকার। আশা করি সরকার এবং বিশ^বিদ্যালয়গুলো এ দিকে নজর দেবে।

লেখক: সাবেক সচিব বাংলাদেশ সরকার।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/579124/