২৯ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:০৬

মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণে অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয় বেড়েছে ১১৭ শতাংশ

সরকারি ব্যয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। করোনা মোকাবিলায় বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে সরকার এখন পর্যন্ত যে টাকা ব্যয় করছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুনতে হয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধে। বিগত ছয় বছরের ব্যবধানে সরকারের সুদ ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। শতাংশ হিসাবে যা ১১৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যেখানে বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা, সেখানে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। এ সময় অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয়ও পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত গত কয়েক বছরে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ নেয়ার কারণে এই ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ব্যাপক হারে ঋণ নেয়ার কারণে সরকারের সুদ ব্যয় প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এই সুদ খাতেই সরকারকে ব্যয় করতে হবে ৬৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছর থেকে চার হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) এই খাতে ব্যয় ধরা রয়েছে ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের সরকারের মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালনা খাতে ব্যয় ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আগামী ৩ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সরকার নতুন বাজেটের আকার ৬ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ধরে এগোচ্ছে, যা শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে-কমতে পারে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে সুদ খাতে বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। বাজেট ব্যয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তি, পরিবহন এবং যোগাযোগ খাতের পরেই রয়েছে সুদ খাতে সর্বাধিক ব্যয়। আগামী অর্থবছরে সুদ খাতে যে ব্যয় হবে তা দিয়ে দু’টি পদ্মা সেতু বা তিনটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা সম্ভব।

জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় শেষ মুহূর্তে আরো খানিকটা বাড়তে পারে। বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, কোভিডের কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বর্ধিত হারে কিছু ঋণসহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এই ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য আরো দুই-তিন শ’ কোটি টাকা খরচ হতে পারে মনে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় ৬৯ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে যেতে পারে। অর্থ বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের ৯০ শতাংশই বরাদ্দ থাকে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে। বাকিটা বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদ, ব্যাংকের মেয়াদি ঋণের সুদ, সরকারি কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ তহবিল বা জিপিএফের সুদ, চলতি ঋণ এবং জীবনবীমা ও অন্যান্য ঋণের সুদ পরিশোধের বিষয়গুলো রয়েছে। এ ছাড়া করোনাকালে নতুন করে প্রণোদনা, ভ্যাকসিন কেনাসহ নানা খাতে সুদ ব্যয় হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সুদ ব্যয় হয় সঞ্চয়পত্র খাতে। এ খাতে সরকারকে ১১ শতাংশের বেশি সুদ প্রদান করতে হচ্ছে।

অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ছয় বছরের ব্যবধানে সরকারের সুদ ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। শতাংশ হিসাবে যা ১১৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যেখানে বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা, সেখানে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। এ সময় অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয়ও পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত গত কয়েক বছরে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ নেয়ার কারণে এই ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় হয়েছে ৫২ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের সুদ ব্যয় চার হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৪৫ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা এবং বিদেশী সুদ ব্যয় তিন হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয় ৩৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের সুদ ব্যয় ছিল তিন হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই ব্যয় যথাক্রমে ৩৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা এবং এক হাজার ৭১১ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৪৪ কোটি টাকা ও এক হাজার ৬২৫ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয় ছিল ২৯ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের সুদ ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা।

এক হিসাবে দেখা গেছে, সরকারি ব্যয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। করোনা মোকাবিলায় বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে সরকার এখন পর্যন্ত যে টাকা ব্যয় করছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুনতে হয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধে। অর্থবছরের (২০২০-২১) জুলাই থেকে নভেম্বর এ ৫ মাসে সরকারের পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৮৮ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধে গেছে ২৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, বন্ড ও বিদেশি সংস্থা থেকে ঋণ করায় সুদ পরিশোধে এসব অর্থ যাচ্ছে। ব্যয়ের বাকি ৬৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা গেছে অন্য ১৩টি খাতে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

এ বিষয়ে বিআইডিএসের সাবেক ডিজি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি জানান, দুর্যোগ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি, নতুন করে আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাবে। এতে ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে ঋণের ওপর আরও নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এছাড়া বিদেশি ঋণ গ্রহণ কঠিন বিধায় অভ্যন্তরীণ ঋণের দিকে যাচ্ছে সরকার। চাইলে এখন সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি সঞ্চয় পত্র থেকে ঋণ গ্রহণে বেশি সুদ দিতে হবে। তবে ঋণ গ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই। এজন্য এখন থেকে এ পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করা যাবে বিশেষ করে কম ব্যয়ের পরিকল্পনা করা দরকার।

জানা গেছে, করোনাসহ স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ব্যয় মেটাতে জুলাই-ডিসেম্বর এ ৬ মাসে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয় ২৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। একইভাবে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হয় ৫৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথম ৬ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। পাশাপাশি অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ট্রেজারি বন্ড থেকে ২৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। এছাড়া গত ১ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে ১৫৬ কোটি ডলার ঋণচুক্তি সই করেছে সরকার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে বিদেশি সহায়তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা যা, গত অর্থবছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি সরকারের ঋণ ও নগদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সরকারের ঋণ গ্রহণের বিষয়টি আলোচনা হয়। বলা হয়েছে ঋণ গ্রহণ বেশি করায় এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতিতে। কারণ যেসব উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে সেখানে সুদের হার অনেক বেশি।

https://dailysangram.com/post/451143