২৭ এপ্রিল ২০২১, মঙ্গলবার, ৮:৫৭

সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক

করোনা সুনামির কবলে ভারত পালিয়ে যাওয়া ১০ করোনা রোগীকে হাসপাতালে ফেরাল পুলিশ ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক, চালক ও হেলপার প্রবেশ করায় করোনা ঝুঁকিতে দেশ

ভারতে করোনা ভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা। করোণা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ইতোমধ্যে দেশের সব সীমান্ত পথ দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও দেশের সব সীমান্তে এক ধরনের অতঙ্ক বিরাজ করছে। এর মধ্যে যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন ভারতফেরত ১০জন করোনা রোগী। এতে করে করোনা ভাইরাসের ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পালিয়ে যাওয়া ১০ জন রোগীকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আবার হাপাতালে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাতে ওইসব এলাকায় করোনা ভাইরাসের ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এ ছাড়া সীমান্তে তৎপর চোরাকারবারী ও মাদক পাচারকারীরা। এদের মাধ্যমেও করোনা ভাইরাসের ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্ড়া, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার কিছু সীমান্তগ্রাম একেবারে ওপার সীমান্তলাগোয়া যার কারণে এসব অঞ্চলে সংক্রমণের ঝুঁকি অত্যন্ত প্রবল। সীমান্তবর্তী এলাকার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। যশোর ব্যুরো জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে ভারতীয় ফেনসিডিল গাঁজা ঢোকে বাংলাদেশে। বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের হাতে ভারতীয় মাদক আটক তার বড় প্রমাণ। গত ১৬ ও ১৮ এপ্রিলও যশোর সীমান্তে ভারত থেকে ঢোকার পথে ৩ লক্ষাধিক টাকার গাঁজা আটক করে বিজিবি। যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্ড়া, মেহেরপুর ও কৃষ্টিয়ার কিছু সীমান্তগ্রাম একেবারে ওপার সীমান্তলাগোয়া যার কারণে সংক্রমণের আশংকা প্রবল হচ্ছে। যদিও বিজিবি কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমান্ত পাহারা জোরদার করেছেন বিজিবির সদস্যরা।
যশোর ব্যাটালিয়ন (৪৯ বিজিবি) এর অধিনায়ক লেঃ কর্নেল মোঃ সেলিম রেজা, বিজিবিএম, পিএসসি গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত বিজিবির কোন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়নি।

সীমান্ত সূত্র জানায়, সীমান্ত কিংবা গ্রাম এলাকায় করোনায় আক্রান্তের ঘটনা একেবারেই হাতেগোনা। করোনার খবর নেই বললেই চলে। দক্ষিণ-পশ্চিমের চেকপোস্ট বেনাপোল, দর্শনা ও ভোমরা দিয়ে ভারত প্রত্যাগত প্রায় অর্ধশত দ্বিতীয় ঢেউএ করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তাদের চেকআপের পর যথারীতি স্বাস্থ্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, ভারত প্রত্যাগত ১০ জন করোনা রোগী যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে করে করোনা ভাইরাসের ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর তাদেরকে আবার আটক করে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনায় সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরপর অভিযোগ উঠে, হাসপাতালের নার্স ও কর্মচারীদের অবহেলার কারণে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। হাসপাতালের ভর্তি রেজিস্টার মতে, ভর্তি রোগীরা হলেন যশোর শহরের বিমান অফিস মোড়ের আবুল কাসেমের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৫৭), খালধার রোডের বিশ্বনাথের স্ত্রী মালা দত্ত (৫০), সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের রবিউল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (১৯), একই গ্রামের একরামের স্ত্রী রোমা (৩০), প্রতাপকাঠি গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে মমিন, রামকান্তপুর গ্রামের গোলাম রব্বানীর স্ত্রী নাসিমা বেগম (৫০), বাঘারপাড়া উপজেলার রায়পুর গ্রামের ফজর আলীর ছেলে শহিদুল ইসলাম (৪৫), ঝিনাইদাহ জেলার কালীগঞ্জের মনোতষের স্ত্রী শেফালি রানী, খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রামরাইল গ্রামের আহম্মদের সানার ছেলে আমিরুল সানা ও একই জেলার রূপসা এলাকার শের আলীর ছেলে সোহেল (১৭)।

তাদের পালিয়ে যাওয়ার পর দেশজুড়ে ভারতের নতুন ধরন নিয়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী যদি কোনো পরিবারে থাকে, তার মাধ্যমে প্রথমে তার পরিবার এবং আশপাশের লোকজনও আক্রান্ত হতে পারেন। যশোর জেনারেল হাসপাতালের একাধিক ডাক্তার বলেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে। ফলে ‹পালিয়ে যাওয়া› রোগীরা যদি ভারতীয় ভেরিয়েন্টের বাহক হন তাহলে তা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে।

সাতক্ষীরা থেকে আক্তারুজ্জামান বাচ্চু জানান, ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ হলেও প্রভাব পড়েনি ভোমরা স্থলবন্দরে। স্বাভাবিক ভাবেই চলছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। অন্যান্য দিনের মতো গতকালও ভারত থেকে তিন শতাধিক পণ্যবাহি ট্রাক ভোমরায় প্রবেশ করেছে। করোনা মহামারি মোকাবেলায় ভারতের সাথে স্থল সীমান্তে যাতায়াত বন্ধ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু স্থল বন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক, চালক ও হেলপার প্রবেশ করায় করোনা ঝুঁকিতেই রয়ে গেছে এদেশ। ঝুঁকিতে রয়েছেন বন্দরের সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, প্রতিদিন শত শত ভারতীয় ট্রাক চালক-হেলপাররা ভোমরা বন্দরে প্রবেশ করেন। করোনার ঝুঁকি নিয়েই তারা এদেশে প্রবেশ করছেন। অধিকাংশ ট্রাক পণ্য খালাস করে দিনের মধ্যেই ভারতে ফেরত গেলেও বেশ কিছু ট্রাক বন্দরে রয়ে যায়। সাথে থাকেন চালক ও হেলপাররা। এরা অধিকাংশই মুর্শিদাবাদ, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের। এরা অবাধে ঘুরে বেড়ানোয় বন্দর থেকে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর আশংকা করছেন এলাকাবাসী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা সংবাদদাতা মো.ইউসুফ সারোয়ার জানান, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রফতানি চালু থাকলেও যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম ইউএসটিসি মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ভারতের ১৩ জন ছাত্রছাত্রী আখাউড়া স্থলবন্দরে আসেন নিজ দেশে যেতে। কিন্ত গতকাল থেকে দুই দেশের যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকায় ওই শিক্ষার্থী আটকা পড়ে যায়। তাদের নিজ দেশে ফেরা অনিশ্চিত পড়েছে। আখাউড়া স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশনের ইনচার্জ আবদুল হামিদ বলেন, গতকাল সকাল থেকে দুই দেশের যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ভারতের ১৩জন ছাত্রছাত্রী নিজ দেশে যেতে আসেন। যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকায় ওই শিক্ষার্থী ভারতে যেতে দেয়া হয়নি। এদিকে আখাউড়া স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালু রয়েছে। গতকাল আগরতলা রফতানি হয়েছে মাছ, সিমেন্ট, রড, প্লাস্টিক, পাইপসহ বিভিন্ন পণ্য।

বেনাপোল থেকে মহসিন মিলন জানান, করোনা সংক্রমণ রোধে সীমান্ত ১৪ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এ কারনে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে শতশত বাংলাদেশি পাসপোর্ট যাত্রী আটকা পড়েছে। বেনাপোল চেকপোস্টে ও বেশকিছু ভারতীয় শিক্ষার্থীরা আটকা পড়েছে। এদের মধ্যে অনেকের ভিসা শেষের পথে। আবার অনেকের কাছে টাকা পয়সা ও নেই।

গতকাল সকাল থেকে বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের মধ্যে পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। তবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। পরবর্তী আর কোন নির্দেশনা না আসলে আগামী ৯ মে পর্যন্ত সময় এ আইন বলবৎ থাকবে। কিন্তু ভারত হঠাৎ করে রোববার থেকে অক্সিজেন রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। আনেকে আবার আমদানি রফতানির সময়ও করোনা সংক্রমণ হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন। বেনাপোল ইমিগ্রেশন স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিকেল অফিসার হাবিবুর রহমান জানান, গত রোববার সর্বশেষ ভারত থেকে ৫৭০ জন বাংলাদেশি ফিরেছেন। এসব যাত্রীর মধ্যে ৩ জন করোনা পজিটিভ ছিল। এরা ভারতে গিয়েই করোনা আক্রান্ত হয়। আক্রান্তদের যশোর সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আর করোনা নেগেটিভ সনদবিহীন ১১ জনকে বেনাপোল রজনীগন্ধা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে আবু তাহের আনসারী জানান, সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন কার্যক্রম দুই সপ্তাহ জন্য ভারতের সীমান্ত বন্ধ। বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন কার্যক্রম ১৪ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলেও দুই দেশের মধ্যে পণ্য বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে মহামারি করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়লেও দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে নেওয়া হয়নি তেমন কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে পাথরসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্রাক স্থলবন্দর হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেও ট্রাকে করা হয় না স্প্রে, চালকদের করা হয় না স্বাস্থ্য পরীক্ষা। অধিকাংশ চালকেরই মুখে মাস্ক নেই। ফলে ভিনদেশি ট্রাকচালকদের কারণে স্থলবন্দরে দিন দিন করোনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয়দের মাঝে। গতকাল দুপুরে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্বসহ সরকারি কোনো বিধি-নিষেধ না মেনেই এই স্থলবন্দর দিয়ে চলছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। দেশি-বিদেশি চালক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের মুখে নেই মাস্ক। দু-একজন মাস্ক পরলেও বেশিরভাগ মানুষের মাস্ক থাকে থুতনি কিংবা পকেটে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় গত এক মাসের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে একজন মারা যায়। বর্তমানে করোনা পজেটিভ রুগী আক্রান্ত সংখ্যা ৬ জন।

https://www.dailyinqilab.com/article/377212/