২৭ এপ্রিল ২০২১, মঙ্গলবার, ৮:৫৩

ভয়াবহ অক্সিজেন সংকটের মুখে দেশের চিকিৎসা খাত

হঠাৎ করেই ভারত থেকে বাংলাদেশে করোনার চিকিৎসায় ব্যবহৃত জরুরি তরল অক্সিজেন আসা বন্ধ হয়ে গেছে। গত চারদিন ধরে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে কোনো অক্সিজেনবাহী গাড়ি আসেনি। অন্যদিকে দেশে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে বাড়ছে অক্সিজেনের চাহিদা। ফলে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বাংলাদেশেও অক্সিজেনের সিলিন্ডার মজুদের হিড়িক পড়েছে। এমন অবস্থায় ভারতের মতো বাংলাদেশেও সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে ভয়াবহ অক্সিজেনের সংকটে মুখে পড়বে দেশের চিকিৎসা খাত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় দেশের হাসপাতালগুলোতে এখন দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১৮০ টন। এর মধ্যে বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘লিন্ডে বাংলাদেশ’ উৎপাদন ও সরবরাহ করছে ৯০ টন। স্পেক্ট্রা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দৈনিক গড়ে সরবরাহ করছে ২৪ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। তারপরও ঘাটতি থাকছে দৈনিক প্রায় ৬৫ টন।

অক্সিজেনের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩টি নতুন উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এসব উৎস থেকে পাওয়া যাবে মোট ৭৫ টন অক্সিজেন। তবে বর্তমানে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান মাত্র ৩৫ টন অক্সিজেন দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লি. দৈনিক ৭ টন, ইসলাম অক্সিজেন ২০ টন এবং এ কে অক্সিজেন লি. ৮ টন সরবরাহ করতে পারবে।

এদিকে দেশে গত কয়েকদিন ধরেই করোনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই আইসিইউতে নেওয়ার পর মৃত্যু হচ্ছে। তাদের লাগছে অক্সিজেন। ফলে দিন যতই গড়াচ্ছে; বাড়ছে অক্সিজেনের চাহিদা। আর অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই মেতেছেন মজুদের নেশায়। বাড়াচ্ছেন দামও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘আগে যে অক্সিজেনের চাহিদা ছিল, তা কোভিডকালে বাড়িয়ে দিয়েছি। গত কয়েক মাসে হুট করেই কোভিড আবার দ্বি-গুণ গতিতে বেড়ে যায়। তারপরও আমরা দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেন চাহিদা মেটাতে পারছি।’

তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ে, তারপরেও আমাদের সমস্ত হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা ঠিকমতো চলছে। ভারতের মতো অবস্থা এখনো হয়নি। যদি আমাদের রোগীর সংখ্যা কমে যায় তাহলে আমরা অক্সিজেন ঘাটতিতে পড়ব না।

ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘বাড়তি চাহিদা পূরণে মূলত ভারত, চীন ও পাকিস্তান থেকে অক্সিজেন আমদানি করা হয়। ভারতে হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তারা অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ করেছে। ফলে করোনা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এই সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের চিকিৎসা খাতে ব্যবহৃত অক্সিজেনের চাহিদার বড় একটি অংশ আমদানি হয় ভারত থেকে। প্রতি মাসে শুধু বেনাপোল বন্দর দিয়েই প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন অক্সিজেন আমদানি হয়ে থাকে। করোনাকালে বেড়েছে অক্সিজেনের চাহিদা। কিন্তু এরমধ্যেই বাংলাদেশে হঠাৎ করেই ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে।

আমদানিকারকরা বলছেন, ভারতীয় রফতানিকারকরা জানিয়েছেন, ভারতীয় অক্সিজেন রফতানি না করতে তাদের ওপর চাপ রয়েছে। তাই ভারতে ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা ভেবে বাংলাদেশে অক্সিজেন রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে। দেশের চিকিৎসা খাতও বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ল বলে জানান তারা।

অক্সিজেন পরিবহনকারী বাংলাদেশি ট্রাক চালকরা জানান, গত চারদিন ধরে বেনাপোল বন্দরে ট্রাক নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু ভারত থেকে কোনো অক্সিজেন বন্দরে প্রবেশ করেনি। অক্সিজেন আমদানিকারকের প্রতিনিধি রাকিব হোসেন জানান, ভারতীয় রফতানিকারকরা তাদের জানিয়েছেন, সংকটের কারণে তারা বাংলাদেশে অক্সিজেন রফতানি করতে পারছে না। এছাড়া রফতানি না করার বিষয়ে ভারত সরকারেরও কিছুটা চাপ রয়েছে।

এদিকে সংকটের আশংকায় বাংলাদেশে করোনার মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুতের হিড়িক পড়েছে। একই কারণে ১০ হাজার টাকার সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ হাজার টাকায়। এরপরও অক্সিজেন পেতে গ্রাহকদের বহু কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। অনেকের কাছে ধর্ণা দিতে হয়।

করোনা শুরুর সময় বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ছিলো ১০-১২ হাজার টাকা। আর রিফিল করতে লাগত তিনশ টাকা। কিন্তু এখন সেই সিলিন্ডারের দাম ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। রিফিল এক থেকে তিন হাজার টাকা। একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাথে ট্রলি, ফ্লো মিটার, ক্যানোলা ও মাস্ক দেয়া হয়। সাধারণত বাড়িতে ব্যবহারের জন্য একটি সিলিন্ডারে এক হাজার ৪০০ লিটারের (১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার) অক্সিজেন থাকে। ব্যবহার করা যায় এক হাজার ২০০ মিনিট।

আগে সিলিন্ডার ভাড়া পাওয়া গেলেও এখন আর তা পাওয়া যাচ্ছে না। তার উপর এক প্রতিষ্ঠান থেকে কিনলে আরেক প্রতিষ্ঠান ‘রিফিলও’ করতে চায় না। তার বদলে প্রতিটি সিলিন্ডার বিক্রি করে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকার ব্যবসায় বেশি মনোযোগ বিক্রেতাদের।

বাংলাদেশে লিনডে’ কোম্পানির উৎপাদিত সিলিন্ডারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও চীন ও তাইওয়ান থেকে আনা সিলিন্ডারও বিক্রি হয়। তেজগাঁও কলোনী বাজার এলাকার লিনডের পরিবেশক আবু তাহের। তার দাবি সরবরাহ না থাকায় কয়েকদিন ধরে কোম্পানিটির সিলিন্ডার দিতে পারছেন না।

পরিবেশকরা বলছেন, এখন তারা যে সংখ্যক সিলিন্ডার পান তার চেয়ে চাহিদা চার-পাঁচ গুণ বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও অনেকে আতঙ্কে ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত করছেন। এছাড়া তাদের কেউ কেউ বিক্রির আগে নিশ্চিত হতে চান গ্রাহকের আসলেই প্রয়োজন আছে কি-না। প্রয়োজন না থাকার পরও অনেকেই সিলিন্ডার কিনে বাসায় রেখে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তিন-চারটাও কিনে রাখছেন কেউ কেউ।

https://dailysangram.com/post/450943