২ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১০:৩২

নির্মম সমাজে নিষ্ঠুর সংস্কৃতি

|| আলমগীর মহিউদ্দিন ||

সমগ্র বিশ্বই যেন এক অস্থিরতার সাম্রাজ্যে নীত হয়েছে। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও সামাজিক ভাবলেশহীনতা সয়ে যাওয়া এক সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, আলোচনা হচ্ছে নয়া উদারবাদী ও তার সাথে চণ্ডনীতি যোগ হয়ে কি এই অগ্রহণীয় অবস্থার উদ্ভব ঘটিয়েছে।
প্রত্যুষে নিদ্রা থেকে উঠে প্রাতঃরাশকালে যাদের খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস তারা আতঙ্কিত থাকে আর কত অনাচার ও ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা সামনে আসবে। ঘটনাগুলো যেন জীবন্ত এবং বিরতি নিতে পারে না।
ম্যাকমাস্টার ও রিয়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেনরি এ জিরো এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে বলেছেন, ‘নয়া উদারবাদী নিষ্ঠুরতার মূল উৎস রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ। তারা ধনবাদ এবং আর্থিক লাভকে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে দেখে বলে সমাজ ভাবলেশহীন হচ্ছে এবং সংস্কৃতি নিষ্ঠুর হয়ে পড়ছে।’
এটা সত্য, এখন নানা বক্তব্য ও প্রচারণায় একটি দাবি অত্যন্ত উচ্চকিত। তা হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দুর্ভাগ্যের জন্য জনগণ নিজেই দায়ী। তাই এর প্রতিরোধের জন্য দুর্ভেদ্য পাঁচিল নির্মাণ করতে হবে। ফলে রাষ্ট্র নানা বাধানিষেধের জালের সৃষ্টি করছে তথাকথিত আত্মনির্ভরশীলতার মোড়কে। সেই সুযোগ গ্রহণ করছে ক্ষমতাবানেরা। স্বার্থরক্ষা, বাধাহীন ব্যক্তিস্বাধীনতা, যেকোনো বিষয়ে গভীর সন্দেহ সব চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের বাহক হয়ে পড়ছে। তখনই স্বৈরাচারেরা আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে।
নয়া চণ্ডরাজের আমলে নিষ্ঠুর সংস্কৃতি কেমন ছিল তার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন অধ্যাপক জিরো। এর মাঝে চৌদ্দটি উল্লেখযোগ্য। ১. বক্তব্যে কখনো নৈতিকতা ও সমবেদনা থাকবে না; ২. যোগ্যতমরাই শুধু থাকবে এমন ভাবধারা প্রধান হয়ে সামাজিক ও গোষ্ঠীগত বিভক্তির চেষ্টা হবে; ৩. ন্যায়পরায়ণতা কথাকে বিশ্বাসঘাতকতা ও অবাধ্যতা বলে গ্রহণ করা; ৪. বিভিন্ন প্রতিবাদী এবং সমালোচনামুখর দলকে বিতাড়ন বা পরিত্যাগ করার কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থনমূলক বক্তব্য; ৫. অজ্ঞতার সামরিকায়ন করা হয় যুক্তির মাধ্যমে নয় বরং প্রতিপক্ষকে লজ্জিত ও অফমানিত করে। পরিশেষে এমন ভাষা ব্যবহার করা হবে যেখানে প্রতিপক্ষ বিভ্রান্ত, ভীত হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ সাধারণ ব্যাপার হবে; ৬. যেকোনো সংহতিকে বিশেষ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা এবং সে সংহতি যদি ক্ষমতাবান প্রচলিত বিষয়কে না গ্রহণ করে; ৭. এমন সব ভাষা এবং বিষয় ব্যবহার করা হবে যা সহানুভূতি বা উপলব্ধির সেতুর সম্ভাবনা থাকে না; ৮. সব সামাজিক সমস্যা বা বিষয় সমাধানের জন্য শুধু শক্তির ব্যবহার করা এবং সালিসি বা মধ্যস্থতাতেও আলোচনার সুযোগ না রাখা; ৯. গণতন্ত্র শব্দটির ব্যবহার হয় সীমিত; ১০. সমালোচনাকারী সংবাদমাধ্যমকে অপবাদ ও নিন্দায় আপ্লুত করে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়; ১১. সব ধরনের সমালোচনামূলক বা ত্রুটি নির্দেশনামূলক প্রণালি শিক্ষা বা নীতিকে নিষিদ্ধ করা হয়; ১২. সবার মাঝে নানাভাবে ভীতি সঞ্চারের পদ্ধতিকে উৎসাহিত করা হয় এবং দায়িত্ব ভাগের মাধ্যমে বোঝাপড়াকে নিন্দা করে অবশেষে স্বাধীন চিন্তাকে সন্ত্রাসের আখড়া বলে চিত্রায়িত করা হয় এবং এমন কর্মকাণ্ডকে গভীরভাবে লক্ষ্যের মাঝে থাকে। এমনকি লক্ষ্য জনগণকে শারীরিকভাবেও সার্চ করে লজ্জিত করার চেষ্টা হয়; ১৩. রাষ্ট্রীয় সব সহায়তা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে এবং স্বনির্ভরতার স্লোগান তুলে জনগণের ব্যক্তিগত সব সুযোগ-সুবিধা সীমিত করার কর্মকাণ্ড জোরেশোরে চলে; ১৪. ক্ষমতাবান ও ধনের গুণগান প্রধান হয়ে পড়ে যেমন টিভি শোগুলোতে অর্থের ও ধনবানদের কর্মকাণ্ডের গুণগান হয় অনবরত।
অধ্যাপক জিরো বলেছেন, ‘এর ফলে মানুষের সহজাত অনুভূতিগুলো প্রস্ফুটিত হতে পারে না। যেমন সমাজ নির্মাণের মূল ভিত্তি একে অন্যের সহযোগিতা হারিয়ে গিয়ে শুধু ব্যক্তিতান্ত্রিকতার রাজত্ব হয় প্রবল। লোভ-লালসা সাধারণ ধারণা হয়ে পড়ে। ফলে সামাজিক অস্থিরতার বিরতি হয় না। এটাই নিষ্ঠুর সংস্কৃতির উদ্গাতা এবং এই সংস্কৃতির নিষ্ঠুরতা সমাজকে ভাবলেশহীন বানিয়ে চণ্ডরাজের উৎপত্তিতে সহায়তা করে। শুধু তাই নয়, এই নিষ্ঠুরতা জন্ম দেয় প্রণালিবদ্ধ পাপ এবং অনৈতিক দায়িত্বহীনতা। সাধারণ মানুষের জন্য তখন তার নিজের জন্য কিছু ভাবার বা বেছে নেয়ার কোনো স্বাধীনতা থাকে না।
আজকের দিনে শক্তির ব্যবহারের সমান্তরালে চলছে আর্থিক নিয়ন্ত্রণের চাঁদা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর হাল ধরছে ধনিক শ্রেণী, যাকে ইংরেজিতে করপোরেট শক্তি বলে বর্ণনা করা হয়। এদের ধন বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রও এগিয়ে আসে। বিখ্যাত ছবি ‘ওয়াল স্ট্রিটে’র একটি চরিত্র গর্ডন গেকোর লোভের চিত্রের মাঝ দিয়ে বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দেখানো হয়েছে, কেমন করে ধনীদের ট্যাক্স কমিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আবার এ কথাও বলা হয়েছে, এভাবে আর্থিক সাশ্রয় হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য সহায়তারও প্রয়োজন পড়বে না। কারণ মহানুভব ধনিক শ্রেণী তখন এর ব্যবস্থা নেবে।
সমাজের এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বিভ্রান্ত হয়। গণতান্ত্রিক দেশে এর প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। কারণ সাধারণ মানুষ প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে লোভী, ক্ষমতাশ্রয়ী লোকদের নির্বাচন করে অথবা এসব শ্রেণীর মানুষেরা শক্তি ও অনৈতিকতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করলেও, তারা প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে না। এই ক্ষমতাবানদের লুটপাট এবং দখলকে স্বাভাবিক মনে করে। ওয়েস্টচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক লরেন্স ডেভিডসন এ অবস্থাকে ‘ক্ষমতার মিলনায়তনে নৈতিক মূর্খতা বুদ্ধিজাড্য’ (মোরাল ইডিয়সি ইন দি হল অব পাওয়ার) বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্টের ‘জেনেভা কনভেনশনের’ জন্মের কাহিনী বর্ণনা করে বলেছেন, ‘এর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের সময় যুদ্ধরত শক্তির ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ। বন্দীদের প্রতি ব্যবহার, আহতদের সেবা দেয়া এবং সবার ওপরে মনুষ্যত্বকে স্থান দেয়া। বিশ্বের ১৯৩টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে এর সমর্থন জানায়। ডেভিডসন প্রশ্ন করেছেন, গত ৬৭ বছরে কি এ ব্যবস্থা সঠিক কাজ করেছে? জবাব তিনিই দিয়েছেন। বলেছেনÑ না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ১৫ লাখ লোক মারা যায়, দেশটি ধ্বংস হয়ে যায়। আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চলছে, চেচনিয়াতে সামরিক অভিযান চলছে। তেমনি আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন-বৈদেশিক আক্রমণ যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জেনেভা চুক্তির কোনো স্পর্শই পড়েনি। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের দায়িত্ব জেনেভা চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা। ডেভিডসন বলেছেন, রেডক্রস কিছু করতে পারে না। ঘটনার পরে শুধু যেন সমুদ্রতীরে নুড়ি কুড়ায়। তিনি বলেছেন, আসলে অজ্ঞতা এবং ভণ্ডামি হলো এর মূল কারণ। ভণ্ডামি এ জন্য যে, যুদ্ধবাজ এবং দখলদারদের কখনো এ চুক্তির অধীনে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতাশীল পক্ষ। সে জন্য অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জেনেভা চুক্তি কেন করা হয়েছিল। এটা হয়েছিল এ জন্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে হত্যাকাণ্ড ও অনাচার শুরু হয়েছিল সেটাকে ঠেকানোর জন্য। তিনি উদাহরণ হিসেবে হেনরি কিসিঞ্জারের ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
স্টিফেন ট্যালবট বলে এক সাংবাদিক ২০০০-এ রবার্ট ম্যাকনামারা ও হেনরি কিসিঞ্জারের ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যাপারে সাক্ষাৎকার নেন। এরা দু’জনই প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। ট্যালবট লিখেছেন, ‘আমি কিসিঞ্জারকে বললাম, এই এখনি আমি ম্যাকনামার সাক্ষাৎকার নিয়ে এসেছি। তাকে ভিয়েতনামের যুদ্ধ সম্পর্কে তার অনুভূতি জানতে চেয়েছি। এ কথা শুনে কিসিঞ্জার কাঁদতে শুরু করল। বারবার চোখ মুছতে থাকল। অবশ্য তার চোখে কোনো অশ্রু ছিল না এবং তার বুহুহু বুহুহু শব্দ করে কান্নাটা বেশ নাটকীয়তাপূর্ণ মনে হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তিনি (ম্যাকনামারা) বুক থাপড়িয়েছেন তো? এখনো নিজেকে দোষী মনে করছেন। তিনি গানের সুরে বুক থাপড়ালেন ঠাট্টার সুরে কথা বললেন, ট্যালবট বর্ণনা করলেন। অবাক ট্যালবট স্মরণ করলেন ক্রিস্টোফার হিচেন্সের ২০০১ সালের বই ‘দি ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’, যেখানে ভিয়েতনামের যুদ্ধের হত্যাকাণ্ডে তার স্পষ্ট সম্পৃক্ততার নজিরগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। ডেভিডসন বলেন, নেতৃত্বে এই নৈতিকতার অবক্ষয় সমাজে এবং রাষ্ট্রে নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয়। এ জন্য সর্বত্র সমাজজীবনে সমবেদনা, সহমর্মিতা এবং ব্যক্তিপর্যায়ের যোগাযোগের মূল্যও নির্মাণ করতে হচ্ছে। এর প্রধান কারণ ক্ষমতাবানদের প্রচার ও সমাজজীবনের নিয়ন্ত্রণ। তারা বিরামহীন চেষ্টা করে সাধারণ মানুষ যেন কোনো বিশ্লেষণে না গিয়ে তাদের দেয়া তথ্যকেই শুধু গুরুত্ব দেয় এবং তা গ্রহণ করে জীবন পরিচালনা করে। এই চিন্তা ও আকাক্সাকে সীমিত করতে পারলে এই ক্ষমতা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা হয় এবং নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘায়িত হয়। তাই এক গবেষক দুঃখ করে বলেছেন, সংবাদমাধ্যম ধনীদের কথার মাধ্যম হলেও, এটা সাধারণ মানুষের কথা বলতে বাধ্য হয় টিকে থাকার জন্য। আর ভালো সংবাদমাধ্যম সংখ্যায় ুদ্র হলেও সে কথাগুলো সবার কাছে পেঁৗঁছে যায়। কারণ পাঠক তখন সহজেই বুঝতে পারে মাধ্যম কার ওকালতি করছে, কোন ভাবধারা প্রচার করছে, নতুন কিছু কি বলছে, দেশ ও জাতির ইতিহাস, ইচ্ছা এবং আকাক্সাকে ধারণ করছে।
এমনটি সম্ভব হলে সামাজিক নিষ্ঠুরতার দেয়াল ধীরে ধীরে পড়ে যেতে থাকে এবং সেখানে এমন সর্বজনীন সংস্কৃতির জন্ম নেয়, যা সমাজের প্রতিটি সদস্যের অধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। নতুবা অনাচার-অত্যাচার-অবিচারের রাজত্বের কোনো শেষ হয় না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/208686