পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। ফাইল ছবি
২৬ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ২:৫০

রাজধানীতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড

মামলা হয় তদন্ত এগোয় না, নজির নেই সাজার

অন্তত নয়টি বড় অগ্নিকাণ্ডে কোনো মামলাই হয়নি - অগ্নিকাণ্ডের পর দায়ীদের শনাক্ত করা গেলেও থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে

বৃদ্ধ বাবা নাসির উদ্দিনের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন অসি উদ্দিন (২২)। মূলত নাসির উদ্দিনের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন ছেলেই। কিন্তু ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যান অসি। ছেলেকে হারিয়ে পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েন নাসির উদ্দিন। ছেলে হারানোর যন্ত্রণা তিনি ভুলতে পারছেন না। চুড়িহাট্টার ওই আগুনে মারা যাওয়া দুই ভাই রানা ও রাজুর বাবা সাহেব উদ্দিনেরও একই হাল। পদে পদে দুই সন্তান হারানোর কথা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ওই আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ ওই আগুনের ঘা না শুকাতেই শুক্রবার ভোররাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার মুসা ম্যানশনে রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডে চারজনের মৃত্যু এবং ২০ জন গুরুতর আহত হন। এ অগ্নিদুর্ঘটনার পর দায়িত্বহীনতায় বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও দায়ী ব্যক্তিরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। মামলা হচ্ছে, তদন্তও চলছে, কিন্তু চার্জশিট আর দেওয়া হচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে চার্জশিট দেওয়া হলেও আটকে যাচ্ছে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে গিয়ে। সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে রাজধানীর অন্তত বড় নয়টি অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। সাজার নজিরও নেই।

হিসাবে দেখা গেছে, গত ১১ বছরে ভয়াবহতার দিক থেকে চারটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ আগুনে শিশুসহ ১২৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। দায়ীরা সবাই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আরও তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলেও দুটির তদন্ত এখনও পর্যন্ত শেষ হয়নি। এছাড়া একটি মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে চার্জশিট দেওয়া হলেও সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে কচ্ছপগতিতে। তদন্তাধীন দুটি মামলায় এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিই জামিনে আছেন। বিচারাধীন মামলার ১৩ আসামির পাঁচজনই পলাতক ও বাকিরা জামিনে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী এক মাসের মধ্যে ওই দুটি মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবু বকর ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা না হওয়া দুঃখজনক। আইনের মাধ্যমেই মানুষ যে কোনো কিছুর সঠিক প্রতিকার পেতে পারেন। মামলা হলে তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করবেন। এসব মামলায় অপরাধীদের যথাযথ সাজার নজির সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে অপরাধীরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। একইসঙ্গে দুর্ঘটনার শঙ্কাও হ্রাস পাবে।

এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড : ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীতে এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলেই ২৫ জন ও পরে হাসপাতালে আরও একজন মারা যান। এছাড়া পরে চিকিৎসাধীন ফায়ারম্যান সোহেলও মৃত্যুবরণ করেন। আর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ৭৩ জন চিকিৎসা নেন। এ ঘটনায় বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিল্টন দত্ত মামলা করেন। মামলায় রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুলসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। মামলার পরপরই আসামি বিএনপি নেতা তাজভিরুল ইসলাম ও ভবনের জমির মালিক আসামি প্রকৌশলী এসএমএইচআই ফারুককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই বছর ৮ এপ্রিল তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। দুজনই জামিনে মুক্ত। লিয়াকত আলী খানও মুক্ত। অন্তত ৩২ বার আদালতের কাছে সময় নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। ডিবি পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে।

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড : ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। স্থানীয় এক ব্যক্তি চকবাজার থানায় মামলা করেন। রাস্তার একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশের বিদ্যুতের ট্রান্সমিটারে আগুন লাগে। সেখান থেকে নন্দকুমার দত্ত রোড চুড়িহাট্টা বিল্ডিংয়ের সামনে সিলিন্ডার ভর্তি দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপে আগুন লাগে। পিকআপের সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হয়ে বাড়ির নিচতলা ও রাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মধ্যে আগুন লাগে। আসামিদের বাড়িতে কেমিক্যাল মজুদ থাকায় আগুন ছড়িয়ে ৬৭ জন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। মামলার এজাহারে ওই দুই আসামির নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে হাসান ও সোহেল বেশি ভাড়ায় আশায় দাহ্য পদার্থ ক্রয়-বিক্রয়কারীদের কাছে ভাড়া দেন। মামলার পরই দুই আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন। ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে তারা এখন জামিনে মুক্ত। ইতোমধ্যেই আদালতে অন্তত ৩৬টি ধার্য তারিখ পার হলেও প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। জানতে চাইলে চকবাজারের ওসি মওদুত হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে। এ বিষয়ে সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সব মিলিয়ে আদালতে চার্জশিট দিতে আর মাসখানেক সময় লাগতে পারে।

তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড : ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন ফ্যাশন কারখানায় ভয়াবহ আগুনে অন্তত ১১২ জন নিহত ও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। পরদিন আশুলিয়া থানার করা মামলায় তাজরিনের এমডি দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যু’র অভিযোগ আনা হয়। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা বিচারাধীন এ মামলার ১৩ আসামি পাঁচজন পলাতক ও বাকিরা জামিনে।

যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মামলাও হয়নি : ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিরপুরের সারেকা গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৫ সালে ঢাকার ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে অগ্নিকাণ্ডে ১০ কর্মী প্রাণ হারান। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সিনটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৭ সালে মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টে ২৭ জন এবং মিরপুর-১ নম্বরের মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলসে আগুনে ২২ শ্রমিক মারা যান। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে ৫৩ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ২০০০ সালে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে ১২ শ্রমিক অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০১ সালে মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুন গুজবে পদদলিত হয়ে ২৪ শ্রমিক মারা যান। ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে সান নিটিং গার্মেন্টে আগুনে ২০ শ্রমিক মারা যান। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ আগুনে শিশুসহ ১২৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার কোনোটিতে মামলা হয়নি। দায়ীরা সবাই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/415501/