২ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১০:২৯

কুসিকে কুশলতার বিজয় এবং ভবিষ্যৎ আশা-আশঙ্কা

|| আবদুল লতিফ মাসুম ||


কথায় বলে ‘সাইলেন্ট ইজ গোল্ড’। নীরবতা ও কুশলতা যে সফলতার বাহন হতে পারে, এবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন তার একটি প্রমাণ। বিনষ্ট নির্বাচনব্যবস্থায় এটি যেন ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নির্বাচনের ফলাফল যে রকম আগাম নির্ধারিত হচ্ছিল, কুসিক নির্বাচন সেখানে ব্যতিক্রম। এ কারণে ব্যতিক্রম যে, ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর এই প্রথমবারের মতো অনুভূত হলো, দেশে নির্বাচন কমিশন রয়েছে। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনের জন্য এটি ছিল প্রাথমিক টেস্ট কেস। এই কমিশনের অধীনে এবারই প্রথম একজন বিরোধী প্রার্থী জয় লাভ করলেন। এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এবং ১৪টি উপজেলা উপনির্বাচনে এক ধরনের গতানুগতিকতা দেখা গেলেও কুসিক নির্বাচন জনগণের কাছে একটি আশার আলো বলে প্রতিভাত হচ্ছে। নির্বাচনটি যে নিরঙ্কুশভাবে নির্ভেজাল হয়েছে তা নয়; তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন এ রকম হতে পারে, তা কমিশন প্রমাণ করেছে।
দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ঐতিহ্য অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ সরকার সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে প্রার্থীর দলীয় পরিচয় প্রচ্ছন্নভাবে জানা থাকলেও তা নির্বাচনকে প্রভাবিত করত না প্রত্যক্ষভাবে; বরং প্রার্থীর সততা, সাহসিকতা ও জনপ্রিয়তা বিজয়ের মাত্রা নির্ধারণ করত। ২০১৩ সালে সরাসরি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করেও পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলÑ বিএনপি বিরাট জয় লাভ করে। এই জয় লাভের ঘটনায় বিএনপি যেমন অতিমাত্রায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, তেমনি ক্ষমতাসীন দল নিজেদের জন্য অশনিসঙ্কেতে আতঙ্কিত হয়। নাড়ির খবর পেয়ে সরকার জনগণকে অগ্রাহ্য করে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে মোতাবেক শক্তিপ্রয়োগ ও ছলচাতুরী প্রয়োগ করে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। বিশেষ করে ঢাকা সিটি করপোরেশনে শাসক দল জেতার জন্য ‘নব কৌশল’ গ্রহণ করে। এবারের কুসিক নির্বাচনে তাদের সে কৌশল ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ওই দিন সকালে ভালো ভোট পড়লেও দুপুরের পর ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা অনেক কেন্দ্রে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারে। কিন্তু প্রথমত বিরোধী দলের কৌশলগত নীরবতা, দ্বিতীয়ত নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, তৃতীয়ত সাধারণ ভোটারদের বুদ্ধিমত্তা বিএনপির বিজয়কে সহজ করে দিয়েছে। বিএনপি যদি তাদের শক্তি-সামর্থ্য প্রকাশ্যে প্রদর্শন করত, তাহলে ভোটের ফলাফল পরিবর্তনের জন্য আওয়ামী লীগ আগেই সতর্ক হয়ে যেত। এ নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ক্ষমতার দাপট বুদ্ধিমত্তা ও কুশলতার সাথে অগ্রাহ্য করা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, অনেকে বুকে নৌকা প্রতীক লাগিয়ে কার্যত ধানের শীষের পক্ষে কাজ করেছেন। অপর দিকে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও প্রিজাইডিং অফিসারদের বেশির ভাগই মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পেরেছেন। কারণ, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ যথাযথ ছিল। মেরুদণ্ডহীন কিছু লোকের সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধিমান কর্মকর্তারাও কুশলতার সাথে সরকারি নেতাদের চাপ ও অন্যায় দাবি অগ্রাহ্য করেছেন। এটা তারা করতে পেরেছেন এ জন্য যে, নির্বাচন কমিশন তাদের প্রধান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় আগের মতোই হতাশ হতে হয়েছে। এরা সরাসরি সরকারের কর্তৃত্বে থাকার কারণে আগের মতোই বশংবদ ভূমিকা পালন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের উচিত এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আমাদের নিচু রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটেও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ব্যতিক্রমধর্মী ছিল। নির্বাচন চলার সময় উভয় প্রার্থী জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন, তারা জনগণের রায় মাথা পেতে নেবেন। সরকারি দলের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা ইতোমধ্যেই জনগণের রায় মাথা পেতে নিয়েছেন। নির্বাচন-পরবর্তীকালে উভয় পক্ষই কম-বেশি দায়িত্বশীল আচরণের পরিচয় দিয়েছেন। যেসব কেন্দ্রে অতি উৎসাহী কর্মীরা অপ্রীতিকর আচরণ করেছে, উভয় প্রার্থীর সংযমের কারণে তা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে উৎসাহিত করবে। এখনো যে জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভবÑ এ প্রত্যয় তাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে যারা হতাশ হয়েছিলেন, তারা কুসিক ফলাফলে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবেন। ইতোমধ্যে যারা নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ হয়তো বিপথগামী হয়েছেন। এখন তারা অন্য চিন্তা না করে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন বলে আশা করা যায়। সিটি নির্বাচন রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা না করলেও ইঙ্গিতবাহী। সবারই মনে থাকার কথা, ২০১৩ সালের নির্বাচনে পাঁচ সিটি করপোরেশনে বিএনপির বিজয় রাজনৈতিক মাইলফলকের কাজ করেছিল। পরে বিএনপি ক্ষমতার প্রান্তসীমায় পৌঁছেও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার ধসের প্রমাণে দলটি ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। প্রথমত, তারা সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের হাতে ক্ষমতা রেখেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল লক্ষ করে, কিছু লোক দেখানো চমক ছাড়া নির্বাচন সবার গ্রহণযোগ্য করার কোনো চেষ্টাই আওয়ামী লীগ করেনি। তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, যেকোনো মূল্যে বিরোধী দলকে ক্ষমতায় আসতে বাধা দেয়া হবে। তার পরের ঘটনা সবারই জানা কথা। কুসিক নির্বাচনের মাধ্যমে এখন সরকার দেখাতে চায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের ওপর নির্ভর করা যায়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কুসিক নির্বাচন নিয়ে ২০১৩ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আওয়ামী লীগ সরকার এ বার্তা দিতে চাচ্ছে যে, তাদের অধীনে বিএনপির জয় লাভ সম্ভব। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না। কুসিক নির্বাচনের মতো আরো ১০০টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি জিতলেও সরকারের কিছু আসে-যায় না। বিরোধী রাজনীতি নস্যাৎ করার জন্য নানা নামে এবং নানা ধরনে বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার যে প্রক্রিয়া চলছে, কুসিক নির্বাচন হয়তো তাকে আরো ব্যাপকতা প্রদান করবে। সরকার আরো বেশি শক্তি প্রয়োগে ভবিষ্যৎ প্রার্থীদের দমন করার প্রয়াস পেতে পারে। ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছেÑ গুম, খুন ও বন্দুকযুদ্ধ বেড়ে গেছে। জঙ্গি আস্তানায় মানুষের মৃত্যুও অনেক বেড়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এসব ঘটনা প্রভাব ফেলবে। ক্ষমতায় যাওয়ার পথ নিষ্কণ্টক করার জন্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নির্যাতনের শাখা-প্রশাখা সম্প্রসারিত হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে শোনা যাচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরি হচ্ছে, যারা ভবিষ্যৎ নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে। কৌশলটি এমন, বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনার সব ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্বাচনে যাতে শক্ত কোনো বিরোধী প্রার্থী না থাকেন, তা আগেই নিশ্চিত করা হচ্ছে হয়তো। নির্বাচনে যাতে কর্মী না পাওয়া যায় এবং বুথে যাতে এজেন্ট না দেয়া যায়, সে রকম অবস্থা সৃষ্টির দিকেই যাচ্ছে ক্ষমতাসীন মহল। সে ক্ষেত্রে কুসিক নির্বাচন বিরোধীদের জন্য বরং নেতিবাচক বার্তাই বহন করে। এই দুর্বিষহ রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে যে জনগণ একটি নীরব বিপ্লব সাধন করেছে, তা সরকারকে সিঃসন্দেহে একটি বার্তা দিয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকারে বিরোধী দলের বিজয় সরকার পরিবর্তনের নিদের্শক নয়। সরকার পরিবর্তনের নিয়ামক যে নির্বাচন, অর্থাৎ আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে না হলে পরিবর্তনের কোনো আশা নেই। সরকার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চাইবে আর বিরোধীরা পরিবর্তন প্রত্যাশী হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী পরিবর্তন প্রত্যাশা করলে তার জন্য সর্বাত্মক ত্যাগ-তিতিক্ষার নিরপেক্ষ প্রস্তুতি নিতে হবে। যেকোনো মূল্যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নইলে ২০১৩ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই কুসিক নির্বাচনের আশাবাদ কাজে লাগিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে নীরব জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে হবে।
লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/208684