২৫ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ২:৩৮

টিকা সরবরাহে এগিয়ে এসেছে চীন ও রাশিয়া তাই দেখে ভারতীয় গড়িমসির অবসান?

কথায় বলে, গরীবের কথা নাকি অনেক বাসি হলে ফলে। আজ নয়, প্রায় দুই মাস আগে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ প্রথম পৃষ্ঠায় ডাবল কলাম শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করেছিল যে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে করোনার টিকার সংকট হবে। তখন এই কথায় কেউ গা করেনি। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? বিগত দুই সপ্তাহ হলো প্রায় সব পত্র পত্রিকায় এখন সেই কথার প্রতিধ্বনি করা হচ্ছে। গত ২১ এপ্রিল বুধবার টিকার বিকল্প উৎস সন্ধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ আয়কাউসের সভাপতিত্বে এক সভা হয়। ঐ সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি বা মহাপরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঐ কমিটি ভারত ছাড়া বিকল্প উৎস, অর্থাৎ অন্য কোনো দেশ থেকে টিকা আমদানির সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজন হলে কমিটি ১৫ জন সদস্য কো অপ্ট করতে পারে। সংগ্রামের ঐ রিপোর্ট তো ছিল দুই মাস আগের। ‘ডেইলি স্টার’ পৌনে দুই মাস আগে একটি রিপোর্ট ছেপেছিল। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি ১৫ মার্চের মধ্যে সরকারকে প্রকৃত পরিস্থিতি জানাবেন। এই দুই মাস বা দেড় মাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই বলুন আর সরকারই বলুন, তারা কি করেছেন? প্রধানমন্ত্রীর হুকুম ছাড়া নাকি গাছের পাতাও নড়ে না। ঠিক আছে। তো, বাংলাদেশ যে টিকার ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে সেই বিষয়টি কি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হয়নি?

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা সরবরাহে যে ঘাটতি যাচ্ছে সেই আলামত কি আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা পাননি? আমাদের মত সাধারণ মানুষ সেই পূর্বাভাস পেয়ে থাকলে তাদের তো না পাওয়ার কথা নয়। চুক্তি মোতাবেক জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি কিস্তিতে ৫০ লাখ ডোজ করে ৬ কিস্তিতে ৩ কোটি ডোজ দেওয়ার কথা। ইংরেজী ‘ডেইলি নিউ এজের’ রিপোর্ট মোতাবেক এই ৩ কোটি ডোজের জন্য মার্কিন ডলারে ১২ কোটি ডালার মূল্য সেরামকে আগাম পরিশোধ করা হয়েছে। আবার অন্যান্য পত্রিকায় বলা হয়েছে যে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আগাম পরিশোধ করা হয়েছে। টাকার অঙ্ক যাই হোক না কেন, ৩ কোটি ডোজের পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। তাহলে আমরা প্রাপ্য টিকা পাব না কেন?

॥ দুই ॥
সেরাম বা ইন্ডিয়ার নানান অসুবিধার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো আমরা শুনবো কেন? সেগুলো তো তাদের মাথা ব্যথা। ৬ কিস্তির মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে পূর্ণ কিস্তিতে এক কিস্তি। অর্থাৎ জানুয়ারিতে এসেছে ৫০ লাখ ডোজ। ফেব্রুয়ারিতে এসেছে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। অর্থাৎ পাওনা টিকার মধ্যে পাওয়া গেছে ৭০ লাখ ডোজ। এর বাইরে প্রথমে ২০ লাখ এবং পরে যে ১২ লাখ- মোট ৩২ লাখ দেওয়া হয়েছে সেটি তো হিসাবের বাইরে। এপ্রিল মাস পর্যন্ত ইন্ডিয়ার কাছে আমাদের পাওনা ৫০+৫০+৫০+৫০ লাখ ডোজ। সমান ২ কোটি ডোজ। পেয়েছি ৭০ লাখ ডোজ। নীট পাওনা (এপ্রিল পর্যন্ত) ১ কোটি ৩০ লাখ ডোজ। মে এবং জুন মাসে আরও ৫০+৫০ লাখ ডোজ- মোট আরও ১ কোটি ডোজ পাওনা। মোট পাওনা ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ। এজন্য পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত থেকে ৫০ লাখ ডোজের জায়গায় ২০ লাখ ডোজ এলো, তখনই তো বিষয়টি ইন্ডিয়ার সাথে টেক্ আপ করা উচিৎ ছিল। মার্চ মাসেও যখন কোনো টিকা এলো না এবং কোনো কোনো গণমাধ্যম যখন জানতে চাইলো যে কেন টিকা আসছে না, তখন সরকারের একাধিক মন্ত্রী পর্যায় থেকে বলা হলো যে, এটি নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নাই। কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন যে বাংলাদেশ সময়মত টিকা পাবে। তাই যদি হবে তাহলে এখন, বা আজকের (২২ এপ্রিল) পত্র পত্রিকায় কেন নেতিবাচক শিরোনাম দেখতে হচ্ছে? ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম, Covishield Export: Uncertain till June-July. Says India’s Serum Institute. অথবা, “সময়মত ভারতের টিকা আসছে না” (প্রথম আলো)। অথবা, “তিন মাস রপ্তানি করবে না সেরাম/ করোনার টিকার বিকল্প উৎসের সন্ধানে বাংলাদেশ” (দৈনিক সংগ্রাম)।

বিকল্প উৎসের বিষয়টি আমি একটু পর আলোচনা করবো। কিন্তু তার আগে একটি প্রশ্ন। এটি একেবারে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন। সেটি হলো, ধরা যাক আজ, অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল কোনো ব্যক্তি সেরামের কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নিলেন (আসলে তো তিনি অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকা নিলেন)। দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। ২ মাস পর মানে ২২ জুন। তার আগেই কোভিশিল্ড বা এ্যাস্ট্রাজেনেকার স্টক ফুরিয়ে যাচ্ছে। ধরা যাক, এরমধ্যে চীন বা রাশিয়া থেকে কিছু টিকা এলো। সেক্ষেত্রে কি দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে রাশিয়া বা চীনের টিকা নেয়া যাবে? অর্থাৎ অক্সফোর্ডের প্রথম ডোজের পর কি অন্যদের দ্বিতীয় ডোজ নেয়া যাবে?

আমি ডাক্তার নই বা ভ্যাকসিন স্পেশালিস্ট নই। তবুও আমার সাধারণ জ্ঞান বলে যে নেয়া যাবে না। যদি তাই হয় তাহলে এখনও ফার্স্ট ডোজ হিসাবে অক্সফোর্ডের টিকা দেয়া হচ্ছে কেন? ২২ এপ্রিলের পত্র পত্রিকায় যে হিসাব এসেছে সেই হিসাব থেকে দেখা যায় যে মঙ্গলবার পর্যন্ত ফার্স্ট ডোজের টিকা নিয়েছেন ৫৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮৫ জন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৯ জন। অর্থাৎ দুই ডোজ মিলে মঙ্গলবার পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৭৪ লাখ ২৩ হাজার ২৭৪ ডোজ টিকা। এই মুহূর্তে দ্বিতীয় ডোজ কমপ্লিট করার জন্য প্রয়োজন ৫৭৪৫০৮৫২ সমান ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৯০ হাজার ১৭০ ডোজ টিকা। সরকারি হিসাব মোতাবেক মোট টিকা পাওয়া গেছে ১ কোটি ২ লাখ। ঘাটতি ১২ লক্ষ ৯০ হাজার ১৭০ ডোজ। সেরাম বলেছে জুলাই মাসের আগে আর কোনো টিকা পাওয়া যাবে না। তাহলে অবশিষ্ট প্রায় ১৩ লাখ অক্সফোর্ডের টিকা কোথায় পাওয়া যাবে?

॥ তিন ॥
বিষয়টি যদি এরকম হয় যে অন্যদের টিকা আসতে আসতে অক্সফোর্ডের যত টিকা প্রয়োজন (প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে) সেই প্রয়োজন সেরাম মেটাবে তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ইন্ডিয়ান টিকার ঘাটতির কথা তো ভারত থেকেই এসেছে। এবং সেই ঘাটতির নানান কারণ বলা হচ্ছে। প্রথমে বলা হলো যে সেরাম যে পরিমাণ টিকা উৎপন্ন করছে তাতে নাকি ভারতের চাহিদাই মিটছে না। তাই যদি হয় তাহলে ভারত শতকরা একশত ভাগ যে দেশীয় টিকা উৎপাদন করছে সেগুলো কে, ব্যবহার করছে? ভারতের নিজস্ব টিকার নাম ‘ভারত বায়োটেক’। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারত বায়োটেক গ্রহণ করেছেন। ভারতবাসী যদি গণহারে ভারত বায়োটেক গ্রহণ করেন তাহলে এ্যাস্ট্রাজেনেকার ঘাটতি দেখা দেবে কেন? মনে হচ্ছে, ভারতীয়দের অনেকেই তাদের নিজস্ব টিকা ভারত বায়োটেক নিতে আগ্রহী নয়। দুই মেয়াদের অর্থাৎ ১০ বছর মেয়াদে যিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব করেছেন সেই মনমোহন সিং স্বয়ং অক্সফোর্ডের টিকা নিয়েছেন। বিশ্ব বিখ্যাত ক্রিকেট তারকা শচীন টেন্ডুলকার অক্সফোর্ডের টিকা নিয়েছেন। পত্র পত্রিকা পড়ে জানা যায় যে ভারতের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি অক্সফোর্ডের টিকা নিয়েছেন।

১৩০ কোটি লোকের দেখ ভারত। সেই জন্য শতকোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন তাদের। এর আগে বলা হয়েছিল যে ফান্ড সংকটের কারণে সেরকম লার্জ স্কেল প্রোডাকশনে যেতে পারছে না। তাদের তহবিলে ৩ হাজার কোটি রূপি প্রয়োজন। ভারত সরকার নাকি এই অঙ্কের তহবিল মঞ্জুর করেছে। তবে অর্থ ছাড় দিতে বিলম্ব হয় বলে সেরাম ব্যাংক ঋণ নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর শোনা গেল, টিকা উৎপাদনের জন্য যে প্রধান কাঁচামাল প্রয়োজন সেটা আমেরিকা থেকে আমদানি করতে হয়। আমেরিকার জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন চান আগামী বছরের মার্চ এপ্রিলের মধ্যে আমেরিকার সমস্ত নাগরিককে টিকা দিতে। এমনকি শিশু কিশোরকেও এই টিকার আওতায় আনা হবে। সুতরাং ২০/৩০ কোটি গুনন ২, সমান ৫০/৬০ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন আমেরিকার। এই বিপুল সংখ্যক টিকার কাঁচামাল মওজুদ রেখে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে শুধু সেটুকুই তারা রপ্তানী করবে। এ কারণে সেরাম ফুল ক্যাপাসিটিতে উৎপাদনে যেতে পারছে না কাঁচামালের অভাবে।

॥ চার ॥
ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রবল আকারে এসেছে। দৈনিক সংক্রমণ ৩ লাখে পৌঁছেছে। দৈনিক মৃত্যু ২ হাজার মার্কে গিয়েছে। দিল্লী, কেরালা প্রভৃতি বড় শহরে রাত্রিকালীন কারফিউ চলছে এই ভয়াবহ এবং প্রবল করোনা মোকাবেলার জন্য ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আগামী ১লা মে থেকে ১৮ বছর এবং তদুর্ধ্ব সকল নাগরিককে টিকা দেয়া হবে। এজন্য ভারত নিজস্ব উৎপাদন ছাড়াও বিদেশ থেকে আমদানি করবে। এজন্য জুন জুলই পর্যন্ত সেরামে উৎপাদিত টিকা বিদেশে রপ্তানি বন্ধ করা হবে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে সেরাম থেকে ভবিষ্যতে টিকা আমদানি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের সিনিয়র অফিসার, এমনকি মন্ত্রীরাও এমন কথা বলেছেন। কিন্তু তারপরেও বিভ্রান্তি বাড়ছে। বিভ্রান্তিতে এবার নতুন করে ঘি ঢেলেছেন ভারতীয় হাই কমিশনার দোরাই স্বামী। দিল্লী থেকে হাই কমিশনার বিমানযোগে ত্রিপুরা নামেন। সেখান থেকে স্থল পথে তিনি ঢাকা আসেন। ঢাকা আসার পথে আখাউড়া স্থল বন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ভারত যতটুকু টিকা উৎপাদন করবে সেখান থেকে সাধ্য মত বাংলাদেশকে দেয়া হবে। ডেইলি স্টারের ২২ এপ্রিল অনলাইন বাংলা সংস্করণের শিরোনাম, “শিগ্গির বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। ভারতীয় হাই কমিশনার।” এখন দেখা যাক, ভারতের ভ্যাকসিন কবে আসে।

সব শেষ খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ রাশিয়ার নিকট থেকে টিকা কিনবে। আবার একই সাথে রুশ ফর্মুলায় টিকা উৎপাদন করবে। তবে শর্ত থাকবে যে রুশ ফর্মুলা গোপন রাখতে হবে। অন্য কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না প্রকাশও করা যাবে না।

অপর এক খবরে প্রকাশ, জরুরি প্রয়োজনে করোনা ভাইরাসের টিকা পেতে চীনের উদ্যোগে নতুন প্ল্যাটফরমে নাম লেখাতে রাজী হয়েছে বাংলাদেশ। প্ল্যাটফরমটির নাম “ইমারজেন্সী ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া।” চীন ছাড়া এই প্ল্যাটফরমের আর চার সদস্য হলো, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, যখন যার দরকার হবে তখন সে এই প্ল্যাটফরম থেকে টিকা নেবে। তিনি বলেন, এটাকে বলা হচ্ছে সাউথ এশিয়া কো অপারেশন বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা। তবে এটি কোনো জোট নয়। চীন উপহার হিসাবে ৬ লক্ষ ডোজ টিকা দেবে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

তবে চীন বা রাশিয়ার টিকা আমদানির কোনো সময়সীমা দেয়া হয়নি।

Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/450717