২৫ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ২:৩৬

সেবা না দিয়ে টাকা নিচ্ছে ওয়াসা

স্যুয়ারেজ লাইনই নেই, তবু পানির সমান বিল

রাজধানীর কাফরুলের সাদেক মসজিদ গলির পশ্চিম প্রান্তে কল্যাণপুর খালের পাড়ে গেলেই দেখা যায়, বেশ কয়েকটি বাড়ির পয়ঃবর্জ্য পাইপ দিয়ে খালে পড়ছে। দুর্গন্ধে পাড় দিয়ে হাঁটাও মুশকিল। এই এলাকায় পয়ঃনালা (স্যুয়ারেজ লাইন) নেই, তাই খালেই ফেলা হয় সব। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা ঠিকই স্যুয়ারেজের বিল আদায় করছে বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর তা বাড়িয়েও চলছে।

এ চিত্র কেবল একটি খালেই নয়, রাজধানীতে যতগুলো খাল রয়েছে তার প্রতিটিতেই এ রকম বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্যের পাইপ সংযুক্ত। এতে উৎসাহও দিয়ে এসেছে ঢাকা ওয়াসা। কারণ রাজধানীর মাত্র এক-চতুর্থাংশ এলাকায় তাদের পয়ঃনালা আছে। তিন-চতুর্থাংশ এলাকার পয়ঃবর্জ্য উন্মুক্ত নর্দমা, স্টর্ম স্যুয়ারেজ ড্রেন, বক্স কালভার্ট বা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ছে। সেসব পয়ঃবর্জ্য খাল-জলাশয়-নদীতে গিয়ে পড়ছে।

গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর খালগুলো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর দুই সিটি করপোরেশন বিষয়টি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। উভয় সিটি করপোরেশনই পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে ঢাকা ওয়াসাকে তাগিদ দিয়েছে; কিন্তু ওয়াসা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এরই মধ্যে দুই সিটি করপোরেশন ঘোষণা দিয়েছে, ৩১ মের পর থেকে কোনো পয়ঃবর্জ্য খাল-জলাশয়ে ফেলা যাবে না। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, প্রত্যেক ভবন মালিককে প্রয়োজনে নিজস্ব সেপটিক ট্যাঙ্ক নির্মাণ করতে হবে।

এ অবস্থায় ভবন মালিকরাও পড়েছেন বিপাকে। কারণ, অনেক ভবনের নিজস্ব সেপটিক ট্যাঙ্ক নেই। নতুন করে তৈরির বাড়তি জায়গাও অনেক ভবনে নেই। নতুন সেপটিক ট্যাঙ্ক করতে গেলে ভবন ভেঙে আবার তৈরি করতে হবে।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, তাদের ভবনটিতে সেপটিক ট্যাঙ্ক রয়েছে। তারপরও প্রতি মাসে ওয়াসাকে স্যুয়ারেজ বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। যে পরিমাণ পানির বিল আসে, সমপরিমাণ স্যুয়ারেজ বিল দিতে হয়।

একই অভিযোগ করেন ১৭০/৪/ডি পশ্চিম কাফরুলের অবকাশ টাওয়ারের বাসিন্দারা। ১৬ খিলগাঁওয়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে তারা একাধিকবার ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। কিন্তু ওয়াসার কর্মকর্তারা বারবারই বুঝিয়েছেন, স্যুয়ারেজের লাইন না থাকলেও বিল দিতে হবে। কারণ, যে পরিমাণ পানি ভবনের বাসিন্দারা ব্যবহার করেন, সমপরিমাণ পানি তো তাদের বাসা থেকে বের হয়। এ জন্যই বিল দিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বলেন, 'আমার বাসা মোহাম্মদপুরে। প্রায় প্রতিদিনই তার বাসার সামনে রাস্তায় মলমূত্র জমে থাকে। এলাকায় স্যুয়ারেজ লাইন নেই। অথচ প্রতিনিয়ত স্যুয়ারেজের বিল দিতে হচ্ছে।'

ঢাকা ওয়াসার একজন প্রকৌশলীও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তার বাসা মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে।

৭৬ শতাংশ এলাকায় স্যুয়ারেজ লাইন নেই: ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, রাজধানীর ২৪ শতাংশ এলাকায় স্যুয়ারেজের লাইন বা পয়ঃনালা আছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি হোল্ডিং যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করে, তার সমপরিমাণ বিল স্যুয়ারেজের জন্য দিতে হয়। অর্থাৎ কোনো ভবনের পানির বিল ১০০ টাকা হলে, তাকে স্যুয়ারেজ বিলও ১০০ টাকা দিতে হয়। বিল না দিলে পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ওয়াসা।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) ঢাকা ওয়াসা পানি বাবদ ৮১৮ কোটি ৭৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আয় করে। আর স্যুয়ারেজ থেকে আদায় করে ৪৬২ কোটি ৫৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু কেবল স্যুয়ারেজ সংযোগ থাকা ভবনের হিসাব করলে আয় হওয়ার কথা ২০৩ কোটি ৭৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

ঢাকা ওয়াসার ওয়েবসাইটেও দেখা গেছে, রাজধানীতে মাত্র ৯৩৬ কিলোমিটার সড়কের সঙ্গে ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইন আছে। অথচ রাজধানীতে দুই সিটি করপোরেশনের রাস্তার পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। এ হিসাবেও স্যুয়ারেজ থেকে এত বিল ওয়াসার আদায় হওয়া সম্ভব নয়। সংশ্নিষ্টরা বলেন, যেসব ভবনের সঙ্গে স্যুয়ারেজের সংযোগ নেই, সেসব ভবনের বিপরীতেও ওয়াসা স্যুয়ারেজের বিল ইস্যু করে। এ জন্যই স্যুয়ারেজ থেকে এত অর্থ আয় করে ওয়াসা। এভাবে স্যুয়ারেজ সুবিধা না দিয়ে বছরে অন্তত আড়াইশ কোটি টাকা নগরবাসীর পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ওয়াসা।

ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার ১০টি অঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি অঞ্চলে স্যুয়ারেজ লাইন আছে। বাকি চারটি অঞ্চলে আংশিক স্যুয়ারেজ লাইন রয়েছে। বাকি চারটি অঞ্চলে একেবারেই লাইন নেই। এ চারটি অঞ্চল হলো বৃহত্তর উত্তরা (অঞ্চল-৯), বৃহত্তর মিরপুর (অঞ্চল ৪ ও ১০) ও বারিধারা ও আশপাশের বিশাল এলাকা (অঞ্চল-৮)। আংশিক স্যুয়ারেজ লাইন আছে লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৩), মহাখালী, গুলশান, তেজগাঁও ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৫), জুরাইন-যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৭) ও মতিঝিল-খিলগাঁও ও আশপাশের এলাকা (অঞ্চল-৬)। এসব এলাকার প্রায় প্রতিটি ভবনের বিপরীতেই স্যুয়ারেজের বিল আদায় করছে ঢাকা ওয়াসা।

প্রয়োজনীয় পয়ঃশোধনও করতে পারে না ওয়াসা: ঢাকা ওয়াসার মাত্র একটি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট রয়েছে নারায়ণগঞ্জের পাগলায়। রাজধানীর পয়ঃবর্জ্য পাইপলাইন দিয়ে পাগলা শোধনাগারে যাবে। এ জন্য মাত্র ২৬টি স্যুয়ারেজ লিফট স্টেশন রয়েছে ওয়াসার। এসব স্টেশনে বর্জ্য জমা হয়। তারপর পাম্পিংয়ের মাধ্যমে পাইপ দিয়ে সেগুলো শোধনাগারে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই লিফট স্টেশনেরও প্রায় অর্ধেক বিকল। তা ছাড়া পাগলা পয়ঃশোধনাগারে রাজধানীর মাত্র ১০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য শোধনের সক্ষমতা রয়েছে।

১৩ বছরে ১৪ বার বেড়েছে বিল: কী পরিমাণ বর্জ্য কোনো বাসাবাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনে প্রবেশ করল, সেটা নির্ধারণ করে কোনো বিল করে না ওয়াসা। ভবনটিতে যে পরিমাণ পানির বিল আসে, ওয়াসা সেই পরিমাণ অর্থ স্যুয়ারেজের বিল করে। ফলে প্রতি বছরই যখন পানির দাম বাড়ানো হয়, একই সঙ্গে বাড়ে স্যুয়ারেজের বিল। গত ১৩ বছরে ঢাকা ওয়াসা ১৪ দফায় পানির বিল বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে স্যুয়ারেজের বিল। গত বছরের মার্চ মাসে এক ধাপে প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয় পানির দাম। সর্বশেষ ২৩ মার্চের বোর্ডসভায় আবারও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব উত্থাপন করে ওয়াসা। তখন ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু করোনাকালীন সংকটের কথা বলে সদস্যরা সম্মতি দেননি।

ঢাকা ওয়াসারই একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, স্যুয়ারেজের জন্য গত দশ বছরে ওয়াসা একটি টাকাও ব্যয় করেনি। অথচ প্রতি বছরই ওয়াসা স্যুয়ারেজের বিল বাড়িয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম শরিফ উদ্দিন বলেন, অনেকবার ওয়াসাকে বলা হয়েছে; কিন্তু তারা গুরুত্ব দেননি। সম্প্রতি খালগুলো সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর ডিএনসিসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওয়াসা এগুলো বন্ধ না করলে ৩১ মের পর বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

প্রায় একই কথা বলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে গত ৬ এপ্রিল একাধিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে। কারণ, এসবের জন্য দোষ হয় সিটি করপোরেশনের। নগরবাসী ভাবে, এগুলোও দেখার দায়িত্ব করপোরেশনের। আসলে তো তা না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার প্রধান নির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল শীর্ষ কর্মকর্তাদের মন্তব্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। তবে জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তফা তারেক বলেন, বাসাবাড়ির সংযোগ খালে সংযুক্ত করতে তারা কখনোই বলেননি। স্যুয়ারেজের লাইন না থাকার পরও যদি ওয়াসা বিল দেয়, সে ক্ষেত্রে কেউ ওয়াসাকে অবহিত করলে সেটা দেখা হবে।

তবে তিনি স্বীকার করেন, যে পরিমাণ এলাকায় স্যুয়ারেজের লাইন থাকার কথা, মহানগরীতে তা নেই।

https://samakal.com/capital/article/210459911