২৫ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ২:৩২

পুরান ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল ব্যবসা

দুই হাজার প্রতিষ্ঠানই অবৈধ

পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ও কেমিক্যালসংশ্লিষ্ট প্রায় ২ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই অবৈধ। এগুলোর কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেই। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করেনি সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি ইস্যু করেনি নতুন কোনো লাইসেন্সও। এরপরও গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে নির্বিঘ্নে অবৈধভাবে চলছে এসব ব্যবসা। ঝুঁকি নিয়ে পরিচালিত এ ব্যবসার কারণে ঘটছে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড। ইতোমধ্যেই ঝরে গেছে দুই শতাধিক প্রাণ। ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি-তাদের প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে না নেওয়ার কারণেই তারা পুরান ঢাকায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

শুক্রবার পুরান ঢাকার আরমানিটোলার অবৈধ কেমিক্যাল গুদামের অগ্নিকাণ্ডে ঝরে গেছেন ৪ জন। আর গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও ২০ জন। এ ঘটনার পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তৎপর হয়ে উঠেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলছে, ওই কেমিক্যাল গুদাম সম্পূর্ণ অবৈধ। কোনো ধরনের সরকারি অনুমোদন নেই প্রতিষ্ঠানটির।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২ হাজার কেমিক্যাল গুদাম-কারখানা রয়েছে। এসব কেমিক্যাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অবৈধ। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই ট্রেড লাইসেন্স নেই। আমরা এসব উচ্ছেদ করতে পারছি না সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য।’

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে পুরান ঢাকা এলাকার কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে আমরা প্রেরণ করেছি। এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ওই কমিটি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। সরকার সিদ্ধান্ত দিলে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক কেমিক্যাল ব্যবসা করছি। এটা সত্য যে, আবাসিক এলাকায় এ ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনিরাপদ। এ কারণে আমরাও এখান থেকে সরে যেতে চাই, কিন্তু সরকার তো কোনো ব্যবস্থা করতে পারছে না।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন আমাদের অবৈধ বলছে। ঢালাও অবৈধ বললে তো হবে না। এক সময় আমাদের ট্রেড লাইসেন্স ছিল, সে আলোকে আমাদের ব্যাংক লোনও (ঋণ) রয়েছে। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশন লাইসেন্স নবায়ন না করলে আমাদের সবকিছু অবৈধ হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। আমরা তো ট্যাক্স-ভ্যাট প্রদান করছি সরকারকে। আমরা কেমিক্যাল পদার্থ আমদানি করতে পারছি। ট্রেড লাইসেন্স মেয়র সাহেবের কারণে হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, মুন্সীগঞ্জের কেমিক্যালপল্লী বা অন্যত্র যেখানে আমাদের শিল্পপল্লী স্থানান্তর করবে, তার আগ পর্যন্ত আমাদের ট্রেড লাইসেন্স না দেওয়া অযৌক্তিক। যখন আমাদের স্থানান্তর করবে, আমরা সে এলাকা থেকে নতুন করে ট্রেড লাইসেন্স করে নেব। আর আমরা গুদাম অন্যত্র সরিয়ে নিলেও পুরান ঢাকায় আমাদের শোরুমগুলো থাকবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সে সময় ১২৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম-কারখানা স্থানান্তরের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কমিটি, সুপারিশ ও উদ্যোগ গ্রহণ করে। পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে নিতে নানা তৎপরতাও ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের।

এমন পরিস্থিতিতে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ও কেমিক্যাল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নতুন ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন বন্ধ করে সিটি করপোরেশন। এভাবে কেটে গেছে এ দীর্ঘ সময়। সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সিটি করপোরেশন পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করতে কোনো ধরনের উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালনা করতে পারেনি। এ সুযোগে আগের বৈধ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এখন পুরান ঢাকার জনজীবনের জন্য বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের আরও অভিমত, নিমতলীর ঘটনার পর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ২০১৯ সালের ফেব্র“য়ারিতে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। যে ঘটনায় ৭৮ জন মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যান। এর ২ বছর পর ২৩ এপ্রিল আরমানিটোলার ঘটনা ঘটত না। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো বড় হওয়ায় আলোচনায় এসেছে। এছাড়া বছরে আরও অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যেখানে প্রাণহানির ঘটনা না থাকলেও অনেক সম্পদ পুড়ে যায়। কোনো আবাসিক এলাকায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম-কারখানার ব্যবসা পরিচালনা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দ্রুত সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান অপসারণ করা প্রয়োজন হলেও সে বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না সংশ্লিষ্টরা।

শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, পুরান ঢাকার কামালবাগ, ইসলামবাগ, চকবাজার এলাকায় নির্বিঘ্নে চলছে কেমিক্যাল বিক্রি ও ব্যবহার। কেমিক্যাল গুদাম থেকে ড্রামে করে বিভিন্ন কারখানা ও ফ্যাক্টরিতে এসব নিয়ে যেতে দেখা গেছে। শুক্রবারও আরমানিটোলায় আগুনের ঘটনার দিনও পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল বিক্রি ও পরিবহণ করতে দেখা গেছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভয়ে সেদিন তারা এ ব্যাপারে অতি সতর্ক ছিল। একদিন পর শনিবার আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে এই ব্যবসা।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, পুরান ঢাকার কামালবাগ বেড়িবাঁধসংলগ্ন গলি সড়কের একটি ঘরের বড় ড্রাম থেকে ছোট্ট ড্রামে কেমিক্যাল ভরছেন শ্রমিকরা। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, ঠেলাগাড়িতে দুটি ট্রলি ইসলামবাগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দুজন। কেমিক্যাল সরবরাহ করা ওই দোকানঘরের কোনো সাইনবোর্ড নেই। ওই দোকানের মালিকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে আগ্রহ দেখাননি। ঠেলাগাড়ির দুই শ্রমিকের (নজরুল ও মনির হোসেন) কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, এসব ড্রামে এক ধরনের তেল। এসব তেল প্লাস্টিক কারখানায় ব্যবহার করা হয়। ছবি তুলতে গেলে দুজনই মাথা নিচু করে ফেলেন। কিছুক্ষণ তাদের পিছু নিলে দেখা যায়, তারা ইসলামবাগের দিকের একটি গলিতে ঢুকে সামনের দিকে এগিয়ে যান।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের (বিসিক) চেয়ারম্যান মো. মোশতাক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম-কারখানা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে আমরা মুন্সীগঞ্জে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আজ আমাদের তদন্ত কমিটি পুরান ঢাকার আরমানিটোলার ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করেছে। আমাদের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, ওই ভবনের কেমিক্যাল গুদাম-কারখানা সম্পূর্ণ অবৈধ। ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না।

তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আশা করছি আগামী বছরের মধ্যে আমরা মুন্সীগঞ্জের কেমিক্যালপল্লীতে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম-কারখানাগুলোকে স্থানান্তর করতে পারব। বিদ্যমান জায়গায় সব প্রতিষ্ঠানের সংকুলান না হলে, পাশে নতুন করে জায়গা নিয়ে সব প্রতিষ্ঠানকে স্থানান্তর করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/415128/