২৫ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ২:৩১

বায়রার নির্বাচন বন্ধ

অভিভাবকহীন জনশক্তি ব্যবসায়ীরা

বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রায় (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ) প্রশাসক বসেছে গত ডিসেম্বর মাসে। নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সংগঠনের সদস্যরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছেন বলে মনে করছেন জনশক্তি ব্যবসায়ীরা। বায়রার সাবেক কমিটির নেতাসহ সাধারণ সদস্যরা বলছেন, করোনাকালে শ্রমিক রফতানি ইস্যুতে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে সাংগঠনিকভাবে বায়রাকেই ভূমিকা রাখতে হয়। প্রশাসক শুধু দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। বায়রার নেতারাই সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে থাকেন। কিন্তু কমিটি না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন শুরুর পর আন্তর্জাতিক বিমানও বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে চরম আর্থিক ক্ষতি ও ভোগান্তির সম্মুখীন হন বিদেশগামী ও ব্যবসায়ীরা। সমস্যা সমাধানে সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার কথা ছিল বায়রার। কিন্তু বায়রাতে নির্বাচিত কমিটি না থাকায় তখন বায়রার সাধারণ সদস্যদের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু রাখার দাবি জানানো হয়। একই সাথে রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদ নামে আরেকটি সংগঠন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে চিঠি দেয়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকার সৌদি আরবসহ পাঁচ দেশে বিদেশগামীদের জন্য বিশেষ ফ্লাইট চালু করে। কিন্তু ফ্লাইট চালু হলেও দিনের পর দিন সমস্যার ডালপালা ছড়াচ্ছে। তাতে বায়রাকেই সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে এগিয়ে আসার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না।

বায়রার সদস্য তথা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও সংগঠন হিসেবে বায়রা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ভুক্ত। বায়রার গত কার্যনির্বাহী কমিটির (২০১৮-২০) মেয়াদ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই শেষ হয়। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩০ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত কমিটির মেয়াদ বাড়ায়। কিন্তু গত ২৩ নভেম্বর হাইকোর্ট এক রায়ে বায়রার কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ বৃদ্ধির মন্ত্রণালয়ের আদেশ স্থগিত করেন। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে গত ২৯ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নূর মো: মাহবুবুল হককে বায়রায় প্রশাসক নিয়োগ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংগঠনের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনাসহ বিধি মোতাবেক পরবর্তী কার্যক্রম ও আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর গত ৩১ জানুয়ারি বায়রার প্রশাসক নূর মো: মাহবুবুল হক সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট বায়রা নির্বাচন বোর্ড এবং তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন আপিল বোর্ড গঠন করেন। যার সব সদস্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিরাজুল ইসলাম উকিলকে চেয়ারম্যান এবং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সুবর্ণা সরকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব প্রণব কুমার ঘোষকে বোর্ডের সদস্য করা হয়। আর নির্বাচনী আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো: আবদুস সামাদ আল আজাদকে। সদস্য করা হয়Ñ বাণিজ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ মাসুকুুর রহমান সিকদার ও মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: সেলিম হোসেনকে। নির্বাচন বোর্ডের তফসিল অনুযায়ী আগামী ২২ মে বায়রার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু গত ১২ এপ্রিল এই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে নির্বাচনী বোর্ড। এর আগে গত ৭ এপ্রিল বাণিজ্য সংগঠন-২ শাখার পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সোলেমান খান স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, করোনার বিস্তার রোধকল্পে জনসমাগম রোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্সপ্রাপ্ত সব বাণিজ্য সংগঠনের বার্ষিক সাধারণ সভা ও কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্ধিত সময়ের মধ্যে বাণিজ্য সংগঠনগুলো সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনপূর্বক তাদের সুবিধাজনক সময়ে সংগঠনের বার্ষিক সাধারণ সভা ও কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন করতে পারবে।

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনায় আরো বলা হয়, ‘যে সব বাণিজ্য সংগঠন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজন এবং নির্বাচন বোর্ড কর্তৃক ঘোষিত তফসিল মোতাবেক নির্বাচন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, সে সব বাণিজ্য সংগঠনের বার্ষিক সভা এবং নির্বাচন সম্পন্ন করতে কোনো বাধানিষেধ নেই।’

বায়রার সাবেক অর্থসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩১ মের মধ্যে বায়রার নির্বাচন দিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাতেও আছে, করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বড় জায়গায়, প্রয়োজনে তা বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রেও নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়।

তিনি বলেন, বায়রার কমিটি না থাকার কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের। এই ধরুন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু হলেও অস্বাভাবিকভাবে টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বিদেশগামীরা যেমন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন, আমরাও ভোগান্তিতে রয়েছি। আমাদেরও তো দায়বদ্ধতা রয়েছে। এ দিকে বিমান চললেও বিএমইটির সেবা সঙ্কুুচিত করা হয়েছে। ট্রেনিং বন্ধ থাকায় স্মার্ট কার্ড দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিমানের টিকিট কেটেও যাত্রীরা যেতে পারছেন না। মেডিক্যাল সেন্টারগুলো খুলে দেয়া জরুরি। গতবার করোনার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জামানত ৫০ শতাংশ সরকার শর্তসাপেক্ষে ফেরত দিয়েছিল।

রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদ সভাপতি টিপু সুলতান বলেন, সবার প্রচেষ্টায় তো বিশেষ ফ্লাইট চালু হলো। কিন্তু এই সেক্টরের অন্যান্য বিষয় সচল না হওয়ায় কর্মী পাঠানো কার্যক্রম মুখ থুবড়ে আছে। দূতাবাসগুলো বন্ধ। প্রায় দুই লাখ ভিসা অপেক্ষমাণ রয়েছে। শুধু বিশেষ ফ্লাইট চালু হয়েছে। বিশেষ ফ্লাইটের সাথে অন্যান্য বিষয় সচল করা দরকার ছিল। টিপু সুলতান বলেন, কার্যত আমরা বন্ধ অবস্থায় আছি। আর বিশেষ ফ্লাইটের অবস্থা হলো, যে টিকিটের দাম ৩০ হাজার টাকা ছিল তার দাম দেড় লাখ চলতেছে। এসব সমস্যা দেখার জন্য বায়রাই ভূমিকা রাখে।

তিনি বলেন, কোর্টের অর্ডার অনুযায়ী ৩১ মের মধ্যে নির্বাচিত বায়রার নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে। ২২ মের নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হলো, এটা শুধু করোনার কারণে নাকি অন্যকোনো কারণ আছে বুঝতে পারছি না।

বায়রার সর্বশেষ কমিটির মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, এখন যে ক্রাইসিস মুমেন্ট, ব্যক্তিগতভাবে কাজ করতে হয়। বায়রাতো এখন ইনঅ্যাক্টিভ, কোনো কাজ হচ্ছে না। ফ্লাইট, টিকিট সমস্যা হচ্ছে, লোকজনের আসা-যাওয়ার সমস্যা হচ্ছে। আমাদের তো প্রতিনিয়ত প্রবাসী-বিমান-স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ করতে হয়। গতবার কোভিডের সময় আমরা (সদ্য বিদায়ী কমিটি) সে কাজটা করেছি। কমিটি না থাকলে ব্যক্তিগতভাবে করা কঠিন। কমিটি না থাকার কারণে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেসব ইলেকশন ডিক্লারড আছে, সেগুলো করা যাবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আছে। কিন্তু ইলেকশন বোর্ড যেভাবে ইলেকশন বন্ধ করেছে সেটা আইন সম্মত নয়।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বায়রার প্রশাসক নূর মো: মাহবুবুল হককে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো: শামসুল আলম ও প্রশিক্ষণ পরিচালন শাখার পরিচালক প্রকৌশলী ড. মো: সাখাওয়াৎ আলীসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত বলে জানা গেছে। বিদেশগামীদের স্মার্টকার্ডসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিএমইটি। সংস্থাটির উপপরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, প্রথম দুই দিন ইমিগ্রেশন বিভাগ বন্ধ ছিল। এরপর থেকে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম চলছে। তবে আজ রোববার থেকে পুরোপুরি ইমিগ্রেশন বিভাগ চালু হবে বলে জানান তিনি। তার ভাষ্যÑ বিদেশগামীদের মধ্যে যারাই বিমানের টিকিট দেখাতে পারছেন, ভিসার মেয়াদ চলে যাচ্ছে। তাদেরই স্মার্টকার্ড দেয়া হচ্ছে। তবে ট্রেনিং ছাড়া কাউকে স্মার্ট কার্ড দেয়ার বিধান নেই বলে জানান এই কর্মকর্তা।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/578004