২৫ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ২:২৪

কৃষকরা ঋণখেলাপি নয়

দেখা অদেখা

দেশের কোথাও বিশেষ কোনো পণ্যের অভাব বা ঘাটতি কখনো কখনো ঘটতেই পারে। কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষ পণ্যের এমন অভাবকে স্থানীয় পরিভাষায় আক্রা বলেই অভিহিত করে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে বহু বিষয় নিয়েই এমন আক্রার কথা লেখা হয়। তবে কোনো পণ্যবিশেষের ব্যাপারে তা সবসময় ঘটে না। এমন হওয়ার একটা বিশেষ কারণ হচ্ছে, আমাদের কৃষকদের কখন কোন শস্যের প্রয়োজন কতটা হতে পারে, তা নিয়ে বিশেষ কোনো হিসাব তাদের থাকে না। এ দেশের কৃষকদের বড় দুর্বলতা এটা যে, তাদের কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে জ্ঞানের অভাব সীমাহীন। আর তা ছাড়া আমাদের কৃষি দফতরের লোকজনের এসব বিষয়ে কৃষকদের সময়োপযোগী করে তুলতে প্রশিক্ষণ দানের ব্যাপারে উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এ দেশের সরকারি কর্মচারীদের সব কিছুতেই যে একটা গা ছাড়া ভাব থাকে, কৃষি বিভাগও এর তেমন ব্যতিক্রম নেই।

যে পণ্যবিশেষের আক্রা নিয়ে উপরে যে কথা বলা হলো, তার চাহিদা সারা দেশে এতটা হয়তো নয় যে, তা নিয়ে গোটা দেশেই হইচই বেধে যাবে। যেমন ধানের উৎপাদন যদি মাত্রাতিরিক্ত কম হয় তবে সরকারের মাথাব্যথা এতটা হবে যে, তা অনেকটা মাইগ্রেনের ব্যথার সমতুল্য অসহ্য যন্ত্রণা হতে পারে । তবে তখন চাল আমদানির তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। একটা উদাহরণও হয়তো দেয়া যায় যে, সম্প্রতি পেঁয়াজের ঘাটতি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল। একটি দেশের সুশাসন বলতে অনেক কিছুকেই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে মোটা দাগে বলা যায়Ñ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসন সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অবহিত থাকা, সদা সজাগ থাকা যাতে সমস্যা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে কোনো দুর্বলতা পরিলক্ষিত না হয়। বস্তুত সরকার স্মার্ট থাকাই হয়তো এক অর্থে সুশাসনের বিষয়টিকে বোঝায়। আসলে বহু ক্ষেত্রেই আমাদের প্রশাসনকে ‘স্মার্ট’ বলা যাবে না। কেননা দেশে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে যা মোকাবেলায় প্রশাসনকে দক্ষ আর পারঙ্গম হিসাবে পাওয়া যায়নি। আমরা কৃষি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যোগ্যতা সাধারণ মাপ কাঠিতে উৎরে যেতে দেখা যায়নি।

বিশেষ করে এই করোনাকালে দেশে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে যাতে কোনো সঙ্কট সৃষ্টি না হয়, তার বিশেষ উদ্যোগ আয়োজন রাখা জরুরি। এক কথায় বলতে গেলে, এটা প্রশাসনের এই মুহূর্তের প্রাইম ডিউটি। এটা আমাদের সবারই জানা যে, কৃষি সেক্টরে দেশের সবচেয়ে বেশি জনশক্তি নিয়োজিত। তারা যাতে কোনো কষ্টে না পড়ে সে সম্পর্কে প্রশাসনের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, করোনা মহামারীতে অসংখ্য লোক কাজ হারিয়ে চরম দরিদ্রাবস্থায় দিন যাপন করছে। এ কথা বিবেচনায় নিয়ে, আমাদের প্রশাসনের সার্বিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র অবহেলার সুযোগ নেই। করোনা মোকাবেলায় সরকার তার সাধ্যের সবটুকুই ব্যয় করছে। প্রশাসনের আর সবাই যেন এমন সমান্তরাল রেখায় চলতে পারি।

আক্রার খবর তথা দুঃসংবাদই আমাদের পত্রিকাগুলোর উপজীব্য বিষয়; এমন ভাবাটা কারো জন্যই ঠিক নয়। সব দেশের সংবাদপত্র বস্তুত সেই সমাজের দর্পণ। আমাদের পত্রিকাগুলোর ভূমিকাও সেটিই। আর তা ছাড়া পত্রিকার সাংবাদিকরা খুবই সংবেদনশীল। দেশের মানুষের দুঃখ কষ্টকে প্রাধান্য দিয়ে খবর প্রকাশ করেন যাতে এসব খবর প্রশাসনের দৃষ্টিতে এলে মানুষের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা হয়। সাংবাদিক হিসেবে এ কথা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, এই কমিউনিটির বহু সদস্যের অভাব অভিযোগ দুঃখ কষ্ট কম নয়। কিন্তু এ কথা হলফ করে বলতে পারি, সাংবাদিকরা নিজেদের কষ্টের কথাটা বলতে একেবারেই অভ্যস্ত নন।

আক্রার বিষয়ে এ লেখা শুরু করেছি বলে এ কথা কারো ভাবা উচিত নয় যে, পত্রিকা ব্যতিক্রমধর্মী কোনো খবর প্রকাশ করে না। প্রায় সব শিল্পোন্নত দেশে শিল্পের সমস্যা সঙ্কট নিয়ে তাদের মাথাব্যথার শেষ নেই। কিভাবে শিল্পের উন্নতি আর প্রসার ঘটবে, সেখানে কত বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে, কর্মীদের আয় রোজগার কতটা বৃদ্ধি করা যাবে, মানুষের জীবনমান কতটা বৃদ্ধি করা যায় সে চিন্তায় প্রশাসন থাকে তৎপর আর বিভোর। এ ক্ষেত্রে শুধু সরকারই কেবল সতর্ক থাকে না, সংসদে যারা সরকারের প্রতিপক্ষ তারাও যদি সংসদে দাঁড়িয়ে সৎ বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ দেয় সেটিও সরকারের সাদরে গ্রহণ করা উচিত। সে মানুষটি যেকোনো দলেরই হোক, তা বিবেচনা করা ঠিক হয় না।

এমনভাবে দেশকে ‘এগিয়ে নেয়ার ব্যাকরণ’টা যদি অনুধাবন করা হয় তবে তা থেকেই প্রকাশ পাবে সততা সহমর্মিতা। কর্মস্পৃহাই মূলত তাদের অগ্রগতির মূল সূত্র। কাজের বিষয়ে তাদের অনীহা বা বিমুখিতা কিংবা দুর্বলতার কোনো নজির নেই। বহু দেশে ব্যক্তি উদ্যোগই সবচেয়ে বেশি কিন্তু তার পরও সরকারের সহযোগিতার এতটুকু ঘাটতি নেই।

এখন যদি আমরা পাশাপাশি আমাদের দেশের কৃষির হাল নিয়ে খানিকটা পর্যালোচনা করি তবে কেবল হতাশায়ই ভেঙে পড়তে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম গরিব ও কৃষিপ্রধান দেশ। আর এ দেশের একটি বৃহৎ জনশক্তি কৃষিজীবী। আমাদের সংসদ বলতে গেলে তাদের ‘সম্মিলন কেন্দ্র’ হয়ে ওঠা উচিত। কিন্তু সেই সংসদে কী আলোচনা হচ্ছে? এসব কথা শুনে কৃষিজীবীর কতটা সুযোগ সুবিধা বাড়ছে আর গরিবি কতটা পিছু হটছে? আজ মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই অর্থাৎ রোজগারের পথ বন্ধ। লাখ লাখ কৃষকের দিন কাটে ভুখা নাঙ্গা অবস্থায়। তাদের ভাগ্যের চাকা আদৌ ঘুরবে কি না জানে না। অথচ খাদ্য বস্ত্র স্বাস্থ্য শিক্ষা আর মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের সংস্থান করার জন্য সরকার ওয়াদাবদ্ধ। যখন যারা ক্ষমতায় যায় তাদেরই এ ধরনের অঙ্গীকার করতে হয়। সরকার বদল হয়। কিন্তু কোথায় সেসব অঙ্গীকার? এই হতদরিদ্র মানুষের ভোট নিয়ে যারা এখন জনপ্রতিনিধি তাদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, সংসদে বসে এ পর্যন্ত কৃষির কতটুকু কী করলেন? জানি, এর কোনো সদুত্তর তাদের কাছে নেই।

সবচেয়ে অবাক হতে হয়, দেশের মানুষ হতদরিদ্র কৃষক শ্রমিক। জানি না, কোন জাদুর বলে সেসব দুস্থ মানুষের প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই প্রচুর অর্থ সম্পদের অধিকারী হলেন। এর সাথে এটাও যোগ করা যায়, এসব ব্যক্তি নিজেদের ব্যবহারের জন্য বহু মূল্যের গাড়ি প্রশাসনের মদদে বিনা শুল্কে কেনার সুযোগ পান কিভাবে? দেশে যদি সত্যিকার শুদ্ধাচার, ন্যায়নীতি আর নিষ্ঠার চর্চা থাকত তবে এমনভাবে অনাচার তথা ক্ষমতা অপব্যবহার করার মতো ফ্রি স্টাইল সুযোগ থাকত কি? বস্তুত এসব শুধু অনাচার বলেই নীরব থাকার কথা নয়, সোজা কথায় এগুলো চরম দুর্নীতি; যা যেকোনো হিতজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের কাছে কেবলই পাপ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে, আমাদের সমাজপতিদের বিবেচনায় এসব কোনো অন্যায় নয়। তা বরং ‘বুদ্ধির খেলা’। এসব যারা চর্চা করে তারাই বস্তুত সম্পদ গড়ার যোগ্যতা রাখে। অথচ দেশে এমন কথার ব্যাপক প্রচার রয়েছে যে, দেশে নাকি নীতিগর্হিত কার্যক্রম দমনের জন্য বহু সংগঠন আর সংস্থা রয়েছে। এদের নিয়ে আমাদের সাধারণের কথা বলতেও নানা ভয়। কেননা তাদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরাই না আবার ফেঁসে যাই। এমন অনেক উদাহরণ তো দেশে বিদ্যমান। তা ছাড়া এখন মিডিয়ার বড় দুর্দিন। তারাও এতটা শক্তি রাখে না যে, তাদের পক্ষে সব সত্য কথা বলার উপায় আছে। কারণ যুদ্ধটা যে সহায় সম্বলের সাথে অসহায়ের। তাই দুর্বল মিডিয়া কিভাবে পেরে উঠবে সবলের সাথে?

বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিস্তর কথা আছে। বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জনৈক সাবেক প্রধান বিপুল অর্থ লুটে নিয়ে স্থলসীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অনিয়ম ফোরজারি তো এক দিন বা দু’দিনে হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানের যারা হিসাব নিকাশ দেখার দায়িত্বে, তারা এতকাল কোথায় ছিলেন? শুধু তাই নয়, এসব দেখা আর অনুসন্ধানের যেসব বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা রয়েছে, তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন? সরকারের এ-সংক্রান্ত যে মন্ত্রণালয় রয়েছে তারাই বা এসব দায়িত্ব এড়াবেন কিভাবে? এ নিয়ে আরো বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সরকার জাতীয় উন্নয়নের যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের বিষয় রয়েছে। এতসব অনিয়মের পর তার সামাল দেয়া হবে কিভাবে? এই অর্থের একটা বড় অংশই তো আসবে বিদেশ থেকে ঋণ হিসাবে। তারই বা দেখভাল হবে কিভাবে? আর এ কথা মনে রাখা দরকার, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বাবদ যে আসবে তা তো দেশে গরিব ও খেটেখাওয়া মানুষের করের পয়সায়ই শোধ করা হবে। তা ছাড়া এসব অর্থে যে প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে সেখানে কি কোনো সাধারণ বেকার মানুষের কাজের সংস্থান হবে?

আগেই বলেছি দেশে তথ্যপ্রবাহ নিয়ে নানা বাধাবিপত্তি বিদ্যমান, তা না হলে এসব নিয়ে আরো বহু অনিয়মের কথা জানা যেত। আরো অনেক অর্থ কেলেঙ্কারির সমাচার মানুষের গোচরীভূত হতো। অর্থ নিয়ে সামান্য অনিয়মের যে তথ্য উপাত্তের কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিছক কেবল আমাদের ধারণা অনুমানের কোনো ভিত্তি থেকে নয়। আন্তর্জাতিক নানা গবেষণা সংস্থা এবং দেশের স্বীকৃত সব সংস্থার তথ্য-উপাত্তের আলোকে মানুষ এসব জেনেছে। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ দুর্নীতির সূচকে আরো নিচে নেমে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ কথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের উপরের মহল এসব অনিয়ম নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ। এসব রোধের চেষ্টা তদবির তাদের পক্ষ থেকে কম হচ্ছে না। কিন্তু অবস্থাটা এমন যে, কম্বলের লোম বাছতে গেলে কম্বলটাই থাকবে না। আমাদের নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও উদ্যোগের কারণেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গতি ধীরে হলেও আছে এবং তা থেমে আছে এ কথা বলা যাবে না। এখানে আরো একটা কথা স্মরণ করতে চাই যে, আমাদের সমকাতারে থাকা বহু দেশ কোভিডের ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। এটা অবশ্যই কৃতিত্ব বলে অভিহিত করতে হবে যে, আমরা কিছুটা সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু এতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। এই ভ্যাকসিন দেশের সবাই পেতে হবে এবং এমন অগ্রযাত্রায় যেন আর পিছিয়ে না থাকি।

শিল্পসমৃদ্ধ দেশ নিয়েই আমরা কথা শুরু করেছিলাম। কারণ একেকটি দেশের বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন আমরা যদি শুধু শিল্প নিয়ে কথা বলতাম, তবে সেটি এতটাই বেমানান হতো যে, এ দেশের জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে শিল্পের অবদান বলতে গেলে তেমন কিছুই নয়। সে জন্য বরং আমরা যদি কৃষি তথা তার সঙ্কট সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলি, তবে সেটি হবে খুবই প্রাসঙ্গিক। কেননা আমাদের জাতীয় আয়ের উল্লেখ করার মতো অংশ কৃষি থেকে আসে। এ দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় কৃষি থেকেই। আর আমাদের খাদ্যের বড় জোগান আসে এই কৃষি থেকেই। তাই কৃষির সমস্যা আর তা দূর করার এবং সম্ভাবনার বিষয়টি নিয়েই কথা হতে হবে, কৃষির প্রতিবন্ধকতা দূর হবে কিভাবে?
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ বসবাস করে গ্রামাঞ্চলে। তাই সাধারণ কারণেই নির্বাচনে সর্বাধিক সংখ্যক জনপ্রতিনিধি বিজয়ী হয়ে আসেন গ্রামাঞ্চল থেকেই। তাই আমাদের সংসদের বৈশিষ্ট্য হওয়ার কথা গ্রামের মানুষের আলোচনার মিলন কেন্দ্র হিসেবে। সেখানে মুখ্য আলোচ্য বিষয় হওয়ার কথা কৃষির যাবতীয় সমস্যা সঙ্কট এবং গ্রামের মানুষের যাবতীয় বিষয়। কিন্তু অবাক হওয়ার কথাÑ সংসদে যা আলোচনা হয়, তার সিকি ভাগও কৃষি নিয়ে হয় না। গ্রামের মানুষ যেন সংসদে অচ্ছুত। তাদের নিয়ে কদাচিৎ কথা হয়। অথচ যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামের, যদি এভাবে তারা অবজ্ঞা আর অবহেলার পাত্র হয়ে থাকেন তবে সেটি হবে বিমাতাসুলভ।

যাই হোক, আমরা উন্নয়ন সংক্রান্ত কিছু কথা উপরে বলেছি। দেশের উন্নয়ন নিয়ে সেসব কথায় প্রকল্প পরিকল্পনায় লোক নিয়োগসহ আর কোনো তথ্য সাধারণের জানা নেই। বিশেষ একটা কথা মনে জাগছে,্ এই সব প্রকল্পের লোক বাছাই, প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ নিয়ে কোনো নীতির কথা মানুষ তেমন শুনেনি। গ্রাম বা বেকার সাধারণ মানুষ কি তার কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যায্য হিস্যা পাবে? এ প্রশ্ন তুলে আমরা এটা বলতে চাইনি যে, কারিগরি কিংবা প্রকৌশলগত সব পদের জন্য গণদাবি তোলা হচ্ছে। তবে সাধারণের যে হিস্যাটা সেসব বিষয়ে সংসদে কি খোলামেলা কথা হবে? জনপ্রতিনিধিরা কি ন্যায্য বিষয়ে সাধারণের পাশে থাকবেন? বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিটি ব্যক্তির সমমর্যাদা আর অধিকারের কথা জোর দিয়ে বলেছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই যুক্তি নিয়ে সংসদ সদস্যরা তাদের পাশে দাঁড়াবেন তো? নাকি তখন খোঁজা শুরু হবে, কে কোন বড় কর্তার জ্ঞাতি বা বান্ধব যাদের ভাগ্যে অগ্রাধিকারের তকমা আঁটা থাকবে। এর পাশাপাশি আরো প্রশ্ন রয়েছে যে, আমরা দেশে প্রচলিত একটা প্রথার কথা জানি। লাখ লাখ টাকার ‘সালামি’তে এ দেশে চাকরি পাওয়ার জন্য যোগ্যতা অর্জন করা যায়। অথচ যোগ্য উপযুক্ত ব্যক্তিরা বঞ্চনার শিকার হয়, এর বহু নজির রয়েছে। সালামি দিয়ে অনুপযুক্ত প্রার্থীরা যখন চাকরি পেয়ে কাজ করেন তখন সেসব কাজ নিয়ে অভিযোগ আর নানা খবর প্রকাশ পায়।

আমাদের ধনিক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সম্প্রতি আর একটি খেতাব যোগ হয়েছে; আর সেটি হলো ‘ঋণখেলাপি’। ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করা; তারপর সেটি ফেরত দেয়ার আর নাম নেই। আগে বহু আর্থিক প্রতারণার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এখন এর সাথে যোগ হলো ঋণখেলাপির কালো অধ্যায়। তবে আরেকটি ভিন্ন এবং অবাক হওয়ার মতো খবর আমরা সম্প্রতি পত্রিকায় পাঠ করেছি। যা সাধারণ লোকসমাজে এমন বোধ বিবেচনা তৈরি করতে পারে যে, সাধারণ দরিদ্র মানুষের মধ্যে কোনো ঋণখেলাপি নেই; যা অনুকরণীয় আর সততার উন্মেষ ঘটাতে পারবে সমাজে। তা ছাড়া পত্রিকাগুলো নিয়ে এমন নেতিবাচক অভিযোগ রয়েছে যে, তারা শুধু সমাজে হতাশা ছড়ানোর জন্য কেবলই নেতিবাচক বিষয় নিয়ে খবর রচনা করে থাকে। এমন ধারণা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়।

সেই সাথে অনেকের ধারণা, ছোটখাটো বিষয় সাংবাদিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এটা ঠিক নয়; এখন আমরা যা লিখছি, তা অন্তত আমাদের কাছে খুব বড় একটা বিষয়। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একেবারেই ভিন্ন বিষয় এ লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। সমাজে সেটি উদাহরণ সৃষ্টিকারী সাধারণ কৃষক সমাজের গল্প। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য সে সংবাদের শিরোনামসহ উদ্ধৃতি করছি এই বিবেচনায় যে, বিশেষ করে সমাজের সেই সব মানুষের জন্য যাদের কথা এ লেখায় কিছু সন্নিবেশিত হয়েছে। সমাজে যে সবাই এক কাতারে চলে এমন নয়; তারও যে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছেÑ তাই তুলে ধরতে চেয়েছি। সম্প্রতি ‘দৈনিক যুগান্তরে’ যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, সে খবরটির শিরোনামটা ছিল ‘কৃষক ঋণ নেন কম, শোধ করেন বেশি’। এখন খবরের বডি থেকেও কিঞ্চিৎ উদ্ধৃতি করছি, দেশের কৃষক যে পরিমাণ নতুন ঋণ নিচ্ছেন, এর চেয়ে বেশি পরিমাণ পুরনো ঋণ তারা শোধ করছেন। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ১৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ১৫ হাজার ৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ঋণ বিতরণ এক হাজার ৮৮ কোটি টাকা বেড়েছে। শুধু ঋণ বিতরণই বাড়েনি। আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে চলতি অর্থবছরে আট মাসে ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তারা ১৫ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। অর্থাৎ তারা এক বছরে এক হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ‘ঋণ পরিশোধে যে ছাড় ছিল, কৃষকরা তা গ্রহণ করেনি। প্রণোদনার ঋণ পাওয়ায় তাদের হাতে উদ্বৃত্ত টাকা চলে গেছে। এই সুযোগে অনেক কৃষক ঋণ পরিশোধ করেছেন। এর ফলে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের তুলনায় পরিশোধের পরিমাণ অনেক বেশি হয়েছে।’

ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা ‘হজম’ করার বহু কাহিনী আমরা এতকাল অহরহ শুনে এসেছি। এমন টাকা হজম করা নিয়ে যাদের কথা শুনি, এমন শুনিনি যে, তারা দরিদ্র কৃষক। বরং আজ নথিপত্র নিয়ে প্রত্যয়ের সাথে বলছি, গরিব কৃষক যে অর্থ ব্যাংক থেকে নেয়, তা বহু গুণে তারা ফেরত দেয়। রাষ্ট্রের প্রতি এই দরিদ্র কৃষকদের দায়বোধ আর প্রতিশ্রুতি যে কম নয়, তা তারা প্রমাণ করেছেন। হ
ndigantababor@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/578045