২৩ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ২:১৭

টিকা নিয়ে মন্ত্রীদের ফাঁকাবুলি

বন্ধুত্বের সুবাদে ভারতকে অন্ধ বিশ্বাসের পরিণতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের করোনাভাইরাসের টিকা সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় দেশের নাগরিকদের টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়েছে। আগে থেকে ভারত ছাড়া অন্যান্য উৎস না রাখায় সঙ্কটে পড়ে এখন রাশিয়া এবং চীনসহ বিকল্প সব জায়গা থেকে টিকা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও কবে নাগাদ এ টিকা মিলবে সে তথ্য নেই কারো কাছে। তবে টিকা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতোমধ্যে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অগ্রিম টাকায় ক্রয়কৃত টিকা কবে পাচ্ছি এবং অন্য কোনো উৎস থেকে টিকা পাচ্ছি কি-না এ নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আর তাই চলমান টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের দুশ্চিন্তা বা অনিশ্চয়তা কাজ করছে। এদিকে প্রতিদিনই ভারতে করোনার চরম অবনতি হচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে আগামী তিন মাস টিকা রফতানির সুযোগ নেই। তাই ইতোমধ্যে পাওয়া ৭০ লাখ ডোজ ছাড়া জুনের মধ্যে সিরাম থেকে চুক্তি অনুযায়ী বাকি ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ পাওয়া যাচ্ছে না বলেই ধরে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ সরকারের একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী প্রতিদিনই তাদের ‘কথার বুলিতে’ দেশকে টিকায় ভরিয়ে দিচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ৩১ মার্চ সংসদে বলেছেন, টিকা নিয়ে কোনো সংশয় নেই, সাড়ে ৬ কোটি ডোজ টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যান্য মন্ত্রীরা বলছেন, ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকেও সরকার টিকা আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। টিকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করলেও সরকারের মন্ত্রীরা এ নিয়ে সঠিক কোনো ধারণা না রেখেই দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে, দু’একদিনের মধ্যেই টিকা হাতে পাচ্ছে বাংলাদেশ। টিকা নিয়ে তাদের বিভ্রান্তিকর মন্তব্য স্বাস্থ্যখাত নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। যদিও গতকাল টিকা সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেছেন, টিকার জন্য ভারতকে ছাড়া ছয় দেশকে নিয়ে জোট করার জন্য চীনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগে থেকেই বিকল্প ভাবা উচিত ছিল। সিরামের বাইরে অন্য কোনো বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ বা কেনার উদ্যোগে সরকারের ঘাটতি থাকায় টিকা নিয়ে এই অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। তাই দ্রæত নতুন উৎস না খুঁজলে টিকা নিয়ে দেশে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে টিকা নিয়ে সঠিক তথ্য না জেনে উপস্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ঠিক নয় বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেছেন, সঠিক সময়ে সিরাম থেকে টিকা না পাওয়ায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বর্তমান ধারা অনুযায়ী, টিকায় ঘাটতি থাকবে। ভারত থেকে কিছু পাওয়া গেলেও এই ঘাটতি থাকবে। তবে আগে থেকেই টিকার বিকল্প উৎস খোঁজা দরকার ছিল। একই সঙ্গে টিকা কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়লে সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, টিকা নিয়ে না জেনে কারোরই মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জনগনকে সঠিক তথ্য জানানো উচিত। কারণ জনগণকে নিয়েই সরকার। আর বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করলে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হবে। যা সরকারেরই ক্ষতি।

সূত্র মতে, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা আসার কথা থাকলেও গত দুই মাসে কোনো চালান আসেনি। সিরাম ইতোমধ্যে জানিয়েছে, আগামী জুন পর্যন্ত ভারত সরকারের টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই সিরাম থেকে অগ্রিম টাকায় ক্রয়কৃত টিকার চালান কবে নাগাদ আসতে পারে, তা কেউ বলতে পারছে না। বাংলাদেশ মূলত ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের টিকার ওপর নির্ভর করে ছিল। সেই টিকা পাওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে আগামী জুনের আগে টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই দ্রæত টিকা পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের সামনে বিকল্প কম। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলেছে, এখন রাশিয়া এবং চীনসহ বিকল্প সব জায়গা থেকে টিকা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সূত্র মতে, দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরুর পর এ পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৫ জন। গত ৮ এপ্রিল দেশে দ্বিতীয় ডোজের টিকা প্রয়োগ শুরু হয়। গতকাল টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ৫১ হাজার ৯৮৮ জন। এদিন প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ১৬ হাজার ৭৮৪ জন। এ পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৬ জন। টিকার প্রথম ডোজ নেয়াদের অনুযায়ী তাদের জন্য দ্বিতীয় ডোজ ব্যবস্থা করলে এখন পর্যন্ত টিকা প্রয়োজন প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ।

অথচ বাংলাদেশ বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে তিন কোটি ডোজ ক্রয়ের চুক্তি থেকে টিকা পেয়েছে ফেব্রæয়ারিতে ৫০ লাখ এবং মার্চে ২০ লাখ। দুই দফায় মাত্র ৭০ লাখ ডোজ। অথচ চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার কথা। এছাড়া ভারত সরকার ফেব্রæয়ারি মাসে ২০ লাখ ডোজ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে গত ২৬ মার্চ ১২ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ মোট টিকা পেয়েছে চুক্তির ৭০ লাখ এবং উপহারের ৩২ লাখ, মোট ১ কোটি ২ লাখ ডোজ। সরকারি হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত যারা প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের জন্যই এখনো টিকা প্রয়োজন আরো ১৪ লাখ। অথচ কোথা থেকে এই টিকা আসবে এখনো তার কোনো উৎস সম্পর্কে জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে সিরামের টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং দেশে প্রতিদিন টিকার চাহিদা বাড়ায় নতুন উৎস থেকে টিকা খুঁজছিল বাংলাদেশ। আর এরই অংশ হিসেবে টিকা পাওয়ার বিষয়ে নতুন করে আশাবাদী করে তুলেছে চীনের ওষুধ-প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম। সিনোফার্ম বাংলাদেশকে করোনাভাইরাসের ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে দেশগুলোতে টিকা উৎপাদন হচ্ছে, এখন সে ধরনের সব দেশের সাথেই যোগাযোগ করে টিকা পাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, টিকা পাওয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আমরা টিকার বিকল্প উৎস খুঁজছি। রাশিয়া এবং চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তারা টিকা দিতে চায়। ইতিমধ্যে আমাদের দুই তিনটা বৈঠকও হয়েছে। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেছেন, মুশকিল হচ্ছে, কেউ না করছে না। টিকা দেবে না, একথা কেউ বলছে না। কিন্তু কবে পাওয়া যাবে, সেই নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম ধাপে বাংলাদেশকে যে এক কোটি ডোজ টিকা দিতে চেয়েছিল, তাও অনিশ্চয়তায় পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশকে আড়াই কোটি ডোজ ‘স্পুতনিক ভি’ কোভিড-১৯ টিকা ক্রয় অথবা স্থানীয়ভাবে তৈরিতে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, রাশিয়ার টিকা সহায়তা প্রস্তাবের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাহিদ মালেক বলেন, রাশিয়া সরকার বাংলাদেশকে আড়াই কোটি ডোজ টিকা কেনা অথবা একই পরিমাণ টিকা স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তারা টিকাগুলো সরবরাহ করতে চায়। এ ছাড়া রাশিয়া সরকার আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে কয়েক ধাপে আরো সাড়ে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনারও প্রস্তাব দিয়েছে। তবে টিকা নিয়ে নানামুখী বক্তব্য টিকাদান কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত এবং মানুষরে মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/376179