২৩ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ২:১০

করোনার চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার

করোনার ব্যয় মিটাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার। ভুক্তভোগিরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে বেড খালি না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন অনেকে। স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা ব্যয় বহন করছেন তারা। আবার অনেকেই ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ঋণ নিচ্ছেন। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে আর্থিক সংকটে পড়ছেন আক্রান্তের পরিবার। ভূক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে বেড খালি না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন তারা।

যাদের কাছে অঢেল টাকা পয়সা নেই, বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্ত কিংবা মাসিক বেতনের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে; তাদের জন্য বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হলে দুর্বিসহ অবস্থায় পড়তে হয়। বেসরকারী হাসপাতালে যারা ভর্তি হন তাদের দুই তিনদিনেই বিল ওঠে ৫০ থেকে ৬০ হাজারের বেশি। আর অক্সিজেন কিংবা আইসিইউ লাগলে আরও অনেক বেশি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালের আকাশচুম্বী চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার চিকিৎসা দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে বহু পরিবার। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালের আকাশচুম্বী চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকেই। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওষুধ কোম্পানি, অক্সিজেন সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারণে নিঃস্ব হয়েছেন তাঁরা।

সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হন বনশ্রীর রুশদীর পরিবারের সাতজন সদস্য। পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে বিভিন্ন হাসপাতালে ছোটাছুটি আর চিকিৎসা বাণিজ্যের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার পড়তে হয় তাদের। রিশাদ আহমেদ রুশদী জানান, জরুরি অবস্থায় প্রতি ঘন্টায় অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য সাড়ে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকটাই নিঃস্ব হয়েছেন বলেও জানান ভুক্তভোগী পরিবারটি।

এমন আরো অনেক পরিবারই প্রিয়জনদের বাঁচাতে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। এমনকি পরিবারের আর কেউ নতুন করে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো সম্ভব না অনেকের। গতবছর করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন সুত্রাপুরের ব্যবসায়ী রাজীব হোসাইনের বাবা। এ বছর আক্রান্ত হয়েছেন তার মা। এক বছরে অক্সিজেনের মূল্যসহ করোনার সার্বিক চিকিৎসা ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সরকারি হাসপাতালের শয্যা সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করছে। এর ফলে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি। আর নিম্নবিত্তদের অনেকেই মারা যাচ্ছেন প্রায় বিনা চিকিৎসায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনা চিকিৎসার ব্যয় নির্ধারণ করে দেয়ার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক নজরদারি কতরতে হবে।

হাসপাতালে বাড়ছে বাইরের মুমূর্ষু রোগী

এদিকে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর চাপ গতকালও কম ছিল। তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগী বাড়ছে। লক্ষণ করোনার হলেও পরীক্ষা না করেই মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন তারা। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে আরও কঠিন পরিস্থিতে আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

সত্তোরোর্ধ্ব সালেহা বেগম। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে এসেছেন ডিএনসিসির করোনা হাসপাতালে। কয়েকদিন ধরে জ্বর, শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট এখনও পাননি। তবে, সিটি স্ক্যানে তার ফুসফুসে সংক্রমণ পেয়েছেন চিকিৎসকরা। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলাতে করোনা রোগীর চাপ তুলনামূলক কম। তবে আগতদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরের।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গুরুতর রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অগ্রাধিকারও পাচ্ছেন তারা। ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, যখন সেখানে কোনভাবেই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না তখনই তারা রোগী নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। আমরা এসব রোগীদের কিন্তু যথেষ্ট অগ্রাধিকার নিয়েই ভর্তি করাচ্ছি। অনেকে ঢাকার অনেক বড় হাসপাতাল থেকে আমাদের এখানে আসতে চাইছিল কিন্তু আমরা তাদের আগে ঢাকার বাইরের রোগীদের অগ্রাধিকার দিয়েছি।

এদিকে পুষ্টি সপ্তাহের ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, মানুষ সচেতন না হলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরেও ভয়াবহ সমস্যায় পড়তে হতে পারে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কেন এলো সেটার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। আমরা করোনার বিস্তার রোধে বিয়ে, জন্মদিনসহ যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করেছি। জনসমাগম নিরুৎসাহে সব ধরনের সভা-সমাবেশ সীমিত করা হয়েছে। করোনার উৎপত্তি স্থানগুলোসহ পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলসহ সব ধরনের মেলা, পিকনিক বন্ধ রয়েছে। এভাবে কিছুদিন চললে আশা করা যায় করোনা সংক্রমণের হার কমে আসবে।

তিনি বলেন, আমরা আর কত চিকিৎসা দেব, হাসপাতলে আর কত শয্যা বাড়াবো। কত হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা দেব, আমরা কত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করবো। হাসপাতালতো আর রাতারাতি বৃদ্ধি করা যায় না। হাসপাতালের বেডওতো রাতারাতি বাড়ানো যায় না। তারপরও আমরা এই অল্প সময়ের মধ্যে আড়াই হাজার বেড থেকে ৭/৮ হাজার বেড বৃদ্ধি করেছি। দশ গুণ রোগীও আমরা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু তারপরও বাড়লে আর সম্ভব হবে না।

অক্সিজেন সংকট

করোনা রোগীদের সেবায় অক্সিজেন নিয়ে একদিকে স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা শহরের আনাচে-কানাচে যেমন ছুটছেন, অন্যদিকে অক্সিজেনের এ বাড়তি চাহিদাকে কেন্দ্র করে চলছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর লুটপাট। গত কয়েক মাসে অক্সিজেন রিফিল মূল্য বেড়ে গেছে চারগুণ। জরুরি সময়ে সিলিন্ডার নিতে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জামানত দিতে বাধ্য হচ্ছেন স্বজনরা। অথচ লাগামহীন এ বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই কর্তৃপক্ষের নজরদারি।

স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, কেউ কারোনা বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়। অনেক সময় যখন দেখা যায় ওই রোগীর অক্সিজেন লেভেল ৯০-এর নিচে নেমে যাচ্ছে তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

যতটুকু সাধ্য, তা নিয়েই সর্বোচ্চ চেষ্টাই যখন কারো মূলমন্ত্র, তখন অনেকে জীবন বাঁচাতে ছুটছেন অক্সিজেন ভাড়া নেয়া যায়, এমন দোকানে। যেখানে কখনো কখনো জামানতই গুনতে হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। সিলিন্ডার প্রতি দৈনিক ভাড়া ২০০-৩০০ টাকা। রিফিল খরচও গত কয়েক মাসে ৮০ টাকা থেকে ঠেকেছে ৩০০ টাকায়। তারপরও অনেকে বাধ্য হয়ে কিনছেন। এদিকে, নিয়ন্ত্রণহীন বাজার করোনা মহামারিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। কোভিড সংক্রমণের কারণে বেড়েছে ফেসবুক ও অনলাইনভিত্তিক শতাধিক প্রতিষ্ঠান। খরচ বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকটে পড়েছেন বলে জানান তারাও।

https://dailysangram.com/post/450505