২২ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১২:২৮

মৃত্যু যেন নিত্যসাথী

দেশ জাতি রাষ্ট্র

রাষ্ট্র বা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মান রক্ষা করা। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায় তখন মানুষের আর দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। একসময় রাজা-বাদশাহরাই ছিলেন সব কিছুর মালিক। তারা যেকোনো সময় দণ্ডের দ্বারা মুণ্ড নিয়ে নিত। সম্পত্তি দখল করে নিত। মানুষকে যখন তখন অপমান অপদস্ত করত। সেই অবস্থা থেকে মানবজাতির উন্নয়ন ঘটেছে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়েছে। একেই বলে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে সম্মতির শাসন। মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের শাসনের সম্মতি দেয়। এর নাম নির্বাচন। এর মানে এই নয় যে, শাসকরা দণ্ড-মুণ্ডের হত্যাকর্তা বনে গেলেন। তাকে শাসন করতে হয় একটি সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে। এর আধুনিক নাম সংবিধান বা শাসনতন্ত্র। সংবিধানে সব কিছু লেখা থাকে না। আইনে সবকিছু বলা থাকে। আইন কারো মুখের দিকে তাকিয়ে রচিত হয় না। আইন সর্বজনীন। সবার জন্য সমান। সরকার এবং দেশের মানুষ কেউই আইনের ঊর্র্ধ্বে নয়। উভয় পক্ষকেই আইন মেনে চলতে হয়। আইন যখন সবার জীবন, সম্পত্তি ও সম্মান নিশ্চিত করে তখন আইনের শাসন কায়েম হয়। আর যখন আইনের তোয়াক্কা না করে শাসকরা যা ইচ্ছা তাই করে তখন বেআইনি ঘটনা ঘটে। সকারের প্রতি আস্থা ও বিশ^াস নষ্ট হলে মানুষ নিজেই আইন হাতে তুলে নেয়। তখন অরাজকতার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এই অরাজকতার প্রমাণ দেয়। এই অরাজকতা আরো প্রবল হয়ে ওঠে যখন সরকার সম্মতির বদলে শক্তি দিয়ে শাসন করে। তখন গণতন্ত্রের মূল চেতনার অবলুপ্তি ঘটে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মান রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ৩২ অনুচ্ছেদে ‘জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ’-এর কথা বলা হয়েছে। পরবর্তী অনুচ্ছেদে গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ দেয়া হয়েছে। এখন কেবলই তা ছাপার অক্ষর। শাসকগোষ্ঠী ওই রক্ষাকবচের ধার ধারে না বলে সর্বোচ্চ আদালত বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন। সে নির্দেশনা কাগুজে আদেশে পরিণত হয়েছে। সর্বশক্তিধর আইন ও শৃঙ্খলাবাহিনী কখনোই তার তোয়াক্কা করেনি। ব্রিটিশ আমলে আইন ছিল ঔপনিবেশিক। পাকিস্তান আমলে আইন ছিল আধা ঔপনিবেশিক। তবুও আইনের প্রয়োগ ও প্রক্রিয়া ছিল সতর্ক। এখন এদেশের মানুষ নাকি স্বাধীন। তবে স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তাÑ তা হলে তারা তা অর্জন করেনি। বরং ঔপনিবেশিক আমলের চেয়ে নগ্ন ও নিষ্ঠুরভাবে তাদের জীবনের অধিকার, সম্পদের অধিকার ও সম্মানের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এ দেশে ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইলের যে ভূমি ও সম্পদ রয়েছে তা যেকোনো একটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সম্পদ নয় তা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ দেশে সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রধান বিচারপতি থেকে সেনা বা নৌকর্মকর্তা এমনকি করোনাকালীন কর্তব্যরত একজন চিকিৎসকের সম্মানও যে নিরাপদ নয়Ñ তার প্রমাণ কি ইদানীং ঘটেনি?

মনীষী রাসকিনের মতো করে বলা যায়, ‘আপনার সম্পত্তি বিনষ্ট হলে আপনি বেঁচে থাকবেন, আপনার সম্মান নষ্ট হলে আপনি কষ্ট পাবেন কিন্তু বেঁচে থাকবেন। কিন্তু জীবন নষ্ট হলে তো বেঁচে থাকবেন না’। এখন এ দেশে জীবন রক্ষা করাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাসক দলের প্রাথমিক আমলে প্রবীণ সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একই শাসক আমলে মানুষ বলতে বাধ্য হচ্ছে আবারোÑ ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। মানুষের জীবন বাঁচানো যেখানে সরকারের মূল দায়িত্ব সেখানে সরকার মানুষ মারছে। মৃত্যু যেন এ দেশের মানুষের নিত্যসাথী হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার মহামারীতে প্রতিদিন জীবন দিচ্ছে মানুষ। করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত বছর থেকে এ পর্যন্ত তাদের গৃহীত কার্যাবলি তুঘলকি কারবার ছাড়া আর কিছু নয়। সান্ত¡না এই যে, এটি প্রকৃতির রুদ্ররোষÑ আল্লøাহর গজব। কিন্তু পুলিশ যখন নির্বিচারে মানুষের প্রতি গুলিবর্ষণ করে, তখন দায় কার? ইদানীংকালে বেশ কয়েকটি ঘটনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, পুলিশ বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। ক. সেদিন বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে পরপর দুই দিন গুলি করে পুলিশ। দ্বিতীয় দিনে প্রথম দিনের মতো ফাঁকা গুলি না করে সরাসরি গুলি করে তারা। এ ঘটনায় পাঁচজন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন তিন পুলিশ সদস্যসহ অত্যন্ত ৩০ জন। শ্রমিকরা তাদের পাওনা শোধ ও নিজস্ব দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে আন্দোলন করছিল। এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন শ্রমিক। অথচ মামলা দেয়া হয়েছে ২২ জন শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দার নামে। অভিযোগ, পুলিশ কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনা প্রমাণ করে, সরকার কি দেশের মানুষের নাকি বিদেশী পুঁজিপতিদের? দেশজ লুণ্ঠনকারী ও বিদেশী বেনিয়ারা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। খ. দ্বিতীয় ঘটনাটি হেফাজতে ইসলামকেন্দ্রিক। ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে মোদিবিরোধী শান্তিপূর্ণ মিছিল চলছিল। এখানে প্রথমত শাসকদলের গুণ্ডারা এবং শেষে পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালায়। দুই ঘণ্টায় এক হাজার একশ’-এর বেশি গুলিবর্ষণ করে তারা। গুলির সংখ্যাই প্রমাণ করে, তারা ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বা বন্দুকবাজ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এর পরের দুই দিনে চট্টগ্রামের হাটহাজারি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। সুতরাং বোঝা যায় যে, কী পরিমাণ গুলিবর্ষণ করেছিল তারা। গ. গুলি চালানোর আরেকটি ঘটনা ঘটে ফরিদপুরের শালথায়। এটা কোনো রাজনৈতিক বিক্ষোভ ছিল না। সেখানে ভূমি সহকারী কমিশনার করোনা শৃঙ্খলা দেখতে বেরিয়ে ছিলেন। তার দুই সহযোগী মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। মানুষজন প্রতিবাদ করলে সাথে থাকা পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা থানা আক্রমণ করে। এভাবে প্রশাসনের অসহিষ্ণুতায় ঘটে যায় তুলকালাম কাণ্ড। এতে নিহত হয়েছে কয়েকজন সাধারণ মানুষ। ঘ. এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় কোভিডের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। ঙ. বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে অগণিত মানুষ হত্যা করেছে। কখনো বা সন্ত্রাসের অভিযোগে আবার কখনো মাদক দমনের নামে। বিরোধীরা অভিযোগ করছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিন্নমতাবলম্বীরা এর শিকার হচ্ছেন। এই পাঁচ ধরনের বাইরে গুমের মাধ্যমে বিগত কয়েক বছরে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। খালে-বিলে, নদী-নালায়, যত্রতত্র মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। সরকার যেহেতু মানুষের জীবন রক্ষার মৌলিক দায়িত্বের ধারক, সুতরাং সব মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব তারা এড়িয়ে যেতে পারে না।

কষ্টের কথা এই যে, বিগত ১২ বছরের হিসাব-নিকাশ নিলে দেখা যায়, এই সরকার রাজনীতির পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগকেই তাদের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। সে কারণে হাজারো মানুষের মৃত্যু তাদের বিচলিত করে না। মানুষ যে এ কারণে দুঃখ ও ক্ষোভে বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে রয়েছে তা তারা টের পায় না। জবাবদিহিতার সব পথ তারা বন্ধ করে দিয়েছে। সমাবেশ করা যায় না। নির্দোষ মানববন্ধনও পুলিশ পিটিয়ে ভঙ্গ করে দেয়। সমলোচনা করলে ধরে নিয়ে যায়। মামলা আর হামলায় জর্জরিত জনজীবন। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা টের পেত মানুষ কত ফুঁসে আছে। ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা কয়েক মাস আগে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সত্যিকার নির্বাচন হলে এরা পালানোর পথ পাবে না। এদের ক্ষমতার উৎস জনগণ না হয়ে হয়েছে পুলিশ। বিগত নির্বাচন এর প্রমাণ। এর পরপরই তারা রাজনীতির ভাষায় কথা বলছে। এই সেদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট অকার্যকর প্রমাণিত হলে আরো শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ এসেছে। এর পরই বাঁশখালীর শ্রমিক নিধন ঘটেছে। জেলায় জেলায় থানাগুলোতে মেশিনগান বসেছে। এমন কি ঢাকার কিছু থানায় মেশিনগানের মহড়া পরিলক্ষিত হয়েছে। মনে হচ্ছে, মানুষকে নিবৃত্ত করার জন্য মেশিনগান হয়ে উঠেছে তাদের একমাত্র উপায়। মেশিনগান শক্তি প্রয়োগের প্রতীক। তাই জনতার ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে আইনজ্ঞদের মতামত এ রকমÑ ‘পুলিশ সরাসরি এভাবে গুলি করতে পারে না। গুলি করার আগে পুলিশ জনতাকে সতর্ক করবে। এরপর জলকামান ব্যবহার করবে। এতেও কাজ না হলে লাঠিপেটা করবে তারপর রাবার বুলেট নিক্ষেপ করবে। জনতাকে যদি কোনোক্রমেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, নিজের জীবন ও অস্ত্র যখন হুমকির মুখে পড়বে কেবল তখনই গুলি চালাতে পারবে। একটি গুলি চালানোর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে দ্বিতীয় গুলি চালাবে। তাও মানুষের বুকে নয়, হাঁটুর নিচে।’ সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করে, পুলিশ নিয়মানুগ ব্যবহার করেনি। দেশজ এবং আন্তর্জাতিক সনদ ও আইনকানুন পুলিশের এই বেপরোয়া গুলিবর্ষণ সমর্থন করে না। সরকার যারা পুলিশ তথা আইন ও শৃঙ্খলাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করবে তারাই যদি পুলিশ বা আমলাতন্ত্রের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে শাসকগোষ্ঠীর দেউলিয়াত্বই ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কথাটা এ রকম, ‘ব্যক্তির পরিবর্তে অস্ত্র যদি ব্যক্তিকে পরিচালনা করে তা বুমেরাং হতে বাধ্য’। একদিন এই শক্তির দানব শাসকগোষ্ঠীকে গ্রাস করবে। অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার যতই বাড়বে ততই বাড়বে যাতনা ভার। কেননা, ‘পাপে পাপ আনে, পুণ্যে আনে সুখ’।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/577397/