২২ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১২:২০

এক শ্রেণীর টাকার পাহাড় ॥ আরেক শ্রেণীর না খেয়ে মরার দশা

ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের ৪৩ শতাংশই কোটিপতিদের
মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : দেশের মানুষের আয় বৈষম্য প্রকট আকার ধা রণ করেছে। লকডাউনে সর্বত্র ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। একশ্রেণী টাকার পাহাড় গড়ছেন। অন্য শ্রেণীর না খেয়ে মরার দশা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। কিন্তু বড় লোক বা ধনীদের আয় বেড়েছে। ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী বেড়ে যাওয়া তারই প্রমাণ। দেশের কোটি কোটি লোক নিঃস্ব হয়েছে বলেই করোনার সময়ও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০টি। এই হিসাবগুলোতে জমা রয়েছে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। যা দেশের ব্যাংকগুলোতে জমা থাকা মোট আমানতের ৪৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ১২ বছরে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সালের মার্চে দেশে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৬৩৬ জন। ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ জন, যা ১৯৭৫ সালে ৪৭ জনে উন্নীত হয়। দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮ জন, ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২ জন, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭ জন এবং ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩ জন।

সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলছে, করোনা মহামারীর প্রভাবে দেশে অনেক শ্রমিক কর্ম হারিয়েছে। এতে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। একই সময়ে ব্যাংকে কোটি টাকার আমানতধারী বাড়ার বিষয়টি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, দেশে কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পরে শহুরে বস্তিবাসী এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের গড় আয় ৮০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। এমন জনগোষ্ঠীর ৬৩ শতাংশ যারা বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তারা অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৮৭৫টি। বছরের ব্যবধানে এ অঙ্কের হিসাব বেড়েছে ৭ হাজার ৯৫৬টি। এছাড়া ডিসেম্বর শেষে ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটির মধ্যে ১০ হাজার ৪৭২টি ব্যাংক হিসাব, ১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটির মধ্যে ৩ হাজার ৫০৭ জন, ১৫ কোটি ১ টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৬৩২টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ১৩৩টি, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে ৭২৫টি, ৩০ কোটি ১ টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮৪টি এবং ৩৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ২৯৪টি আমানতকারী হিসাব রয়েছে। এছাড়া ৪০ কোটি ১ টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭৮টি, যা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছিল ৩৮৪টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাব সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৩৯০টিতে উন্নীত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২০ সালের ডিসেম্বরের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারী হিসাবের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি। এর মধ্যে কোটি টাকার উপরে রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৩ দশমিক ১৬ শতাংশই কোটিপতিদের দখলে। ব্যাংকে কোটি টাকার উপরে রয়েছে- এমন হিসাবধারী গ্রাহকের আমানতের মোট পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার ৪৯০। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতিদের হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৬ হাজার ৪০০টি। সেপ্টেম্বরে মোট আমানত জমা ছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কোটিপতি হিসাব ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯টি। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব বেড়েছে ১০ হাজার ৫১টি।

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, কোটিপতিদের আমানত বেড়ে যাওয়া এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন তিনি। কোটিপতি যাদের সম্পদ অনেক, তাদের আয়ও বেশি। মহামারিতে তাদের ইনকাম কমেনি। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলো খুব লসে নেই। কোভিডে বড়লোক শ্রেণির মানুষের আয় কমেনি বরং ব্যয় কমেছে। কারণ আগে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণে যেত, অনেক পার্টির আয়োজন করতো এসব এখন পরিস্থিতির কারণে বন্ধ রয়েছে তাই খরচ কমেছে। এছাড়া তারা আপদকালীন সময়ের জন্য ব্যাংকে টাকা রাখছেন। যেন কোনো সমস্যা হলে খরচ করতে পারেন। পাশাপাশি মহামারির কারণে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন। এসব কারণে কোটি টাকার আমানত বেড়েছে।

গত এক বছরে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবগুলোতে আমানত বেড়েছে ৬৮ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে খোলা মোট হিসাব সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি। সেই হিসেবে কোটি টাকার বেশি জমা থাকা ব্যাংক হিসাবের হার শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতি ব্যাংক হিসাব ছিল ৮৭ হাজার ৪৯০টি। এতে আমানত জমা ছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে কোটিপতি হিসাব বেড়েছিল ১১ শতাংশ বা ৮ হাজার ২৭৬টি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে ১ কোটি বা তারচেয়ে বেশি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার ৫৬৩।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে কোটিপতি সংখ্যাবৃদ্ধির এই হার ইঙ্গিত দেয় যে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা আরও গরিব। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ও সামাজিক ক্ষোভ তৈরি হতে পারে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই জাতীয় বৈষম্য দেশের প্রাথমিক উন্নতির সময়ে বাড়তে থাকে, যা পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে কমে আসে।

গত জানুয়ারির বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, করোনা মহামারিতে দেশে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, করোনাকালীন সময়ে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। বিবিএস বলছে, গত বছর ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর বিবিএস ৯৮৯টি পরিবারের ওপর টেলিফোনে ওই জরিপ চালায়। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনার আগে গত মার্চ মাসে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্ট মাসে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা।

জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) সহযোগিতায় প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জানান, করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। কিন্তু বড় লোক বা ধনীদের আয় বেড়েছে। ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী বেড়ে যাওয়া তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, দেশের কোটি কোটি লোক নিঃস্ব হয়েছে বলেই করোনার সময়ও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। ব্যাংক থেকে লুট করে একটি শ্রেণি কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। আবার তারাই হয়তো ব্যাংকে টাকা রাখছেন। তিনি আরও বলেন, নামে অথবা প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বাড়া মানেই কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিনি উল্লেখ করেন, অতি ধনী বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেও এমন চিত্রই উঠে এসেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ কোটি ডলার বা আড়াইশ’ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ওয়েলথ-এক্সের হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ হারে। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ মোট ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি।

https://dailysangram.com/post/450389