২০ এপ্রিল ২০২১, মঙ্গলবার, ৪:৩৯

ভ্যাকসিন কূটনীতি নিয়ে আবারও তৎপর বাংলাদেশ

দুনিয়াব্যাপী খবরের কেন্দ্রবিন্দু এখন করোনার ভ্যাকসিন। কারণ, করোনা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশও বসে নেই আবারও করোনার ভ্যাকসিন পেতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। ভারত থেকে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন এখনও না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী অন্যকোন দেশ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়া যায় কিনা, সে লক্ষ্যে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ চীন এবং রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যোগাযোগ করেছে। এদিকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে গত বছরের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ চুক্তি করে। জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ দেশে এলেও বিপুল চাহিদা আর বিশ্বজুড়ে টিকার সরবরাহ সঙ্কটের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ২০ লাখ ডোজ হাতে পায়। ভারত সরকারের উপহার হিসেবেও ৩২ লাখ ডোজ টিকা পায় বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত মোট টিকা এসেছে বাংলাদেশে এক কোটি দুই লাখ ডোজ। এদিকে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে গতকাল সোমবার গত ২৪ ঘন্টায় রেকর্ড সংখ্যক আরও ১১২ জন মারা গেছেন। এই নিয়ে টানা তিনদিনে করোনায় প্রতিদিন গড়ে একশ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২৭১ জন।

ভ্যাকসিন কূটনীতির ইতিহাস অনেক পুরোনো। আভিধানিক অর্থে এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবহার হলো ভ্যাকসিন কূটনীতি। উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রতি চীন ও ভারতের বিশেষ আগ্রহের কথা তুলে ধরতে পারি। ব্যাপক অর্থে ভ্যাকসিন কূটনীতি বলতে শুধু অর্থায়নকে বুঝায় না, বরং ভ্যাকসিনের আবিষ্কার, কেনা-বেচা, সরবরাহের জন্য কৌশলগত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিনিময় এই কূটনীতির অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য কূটনীতির একটি শাখা হলো ভ্যাকসিন কূটনীতি, যার কারণে দা-কুমড়ো সম্পর্কের রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র এক ঘাটে জল খেয়েছিল।

চীন এই মুহূর্তে তাদের ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের আগাম বুকিং থাকার কারণে বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দিতে পারছে না বলে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রাশিয়া বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হলে তাতে সহ-উৎপাদক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা বিশ্বাস করি চুক্তি অনুযায়ী ভারত করোনা ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে।

এদিকে কোভ্যাক্সের আওতায় থাকায় আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কিন্তু ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি যতই ঘনীভূত হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর খুব সহসা ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। প্রথমদিকে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে সবার জন্য দুয়ার খোলা নীতি গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ। চীনকে যেমন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে আবার তার বিরোধী পক্ষ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটি অব ইন্ডিয়ার সাথে চুক্তি করে রেখেছে। চুক্তি অনুযায়ী, সেরাম ইনস্টিটিউট ছয় মাসের মধ্যে তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশে সরবরাহ করবে। তবে সম্প্রতি ভারতের নিষেধাজ্ঞার আকস্মিক খবর মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাংলাদেশের জন্য। যদিও দু'দেশের সরকার নীতি অনুয়ায়ী বাংলাদেশ ভারত থেকে ভ্যাকসিন পায় ।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের সবশেষ (৫ জানুয়ারি ২০২১) তথ্যানুযায়ী, ৭টি ভ্যাকসিন এ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর মধ্যে বায়োএনটেক/ফাইজারের ভ্যাকসিনটি সর্বাধিক ৪৮টি দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া মডার্না ২টি, স্পুটনিক-ভি ৪টি, অক্সফোর্ড/এসট্রাজেনকা ৫টি, চীনের সাইনোফার্ম ৫টি, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড এবং বায়োটেকের কোভাক্সিন ১টি দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর মধ্যে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল সর্বাধিক ১২টি দেশে হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭৩টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে, যা আমাদেরকে আশার আলো দেখাচ্ছে। এর মধ্যে ১৮টি ভ্যাকসিন ৩য় পর্যায়, ৩২টি ভ্যাকসিন ২য় পর্যায় এবং আরো ২৩টি ভ্যাকসিন ১ম পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে। বিশ্বের মাত্র ৪৩টি দেশে কোভিড ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

ইউরোপের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেন্ডের বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন পাওয়া না গেলে আগামী এক বছরে বিশ্ব অর্থনীতির জিডিপিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব হবে তিন দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলার। আর ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে পরিমাণ দাঁড়াবে এক দশমিক দুই ট্রিলিয়ন। কিন্তু এক দিকে বছরের শেষে এসে কোভিড-১৯ এর নতুন ধরন এবং অন্যদিকে সব মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে সারাবিশ্বে চলছে ভ্যাকসিন কূটনীতি। ঐতিহাসিকভাবে ভ্যাকসিন কূটনীতি একটি প্রমাণিত শক্তি হলেও ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ-এর কাছে তা অনেকবারই পরাস্ত হয়েছে। পরিণামে বেড়েছে উত্তর-দক্ষিণে অবিশ্বাস।

ভ্যাকসিন কূটনীতি বিষয়ে একজন প্রসিদ্ধ গবেষক পিটার জে হটেজ। ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ জার্নালে ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ১৮০০ থেকে ১৮০৫ সালে গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে রাশিয়া, তুরস্ক, স্পেন, মেক্সিকো, ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভ্যাকসিন কূটনীতির প্রথম সফল প্রয়োগ হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যকার দফায় দফায় যুদ্ধ ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে দিয়েছিল বৃটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেন্নারের পোলিও'র ভ্যাকসিন আবিষ্কার। ঘোর শত্রু দেশের জাতীয় ইনস্টিটিউটকে পাঠানো চিঠিতে এডওয়ার্ড বলেছিলেন, বিজ্ঞান কখনো যুদ্ধের জন্য নয়। সবশেষ ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কিছু রোগের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। আর সম্প্রতি কভিডের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তাতে ভ্যাকসিন কূটনীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। হটেজ মনে করেন, ভ্যাকসিন হলো বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর হাতিয়ার। উদাহরণ হিসেবে চীনের সাম্প্রতিক হেলথ সিল্ক রোড নীতির কথা বলা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন কোভিড ভ্যাকসিনকে একদিকে তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধার, অন্যদিকে প্রভাবের বলয় বিস্তারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। ধনীদের ভ্যাকসিন অলীক স্বপ্ন মনে করে অনেক দেশই এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের প্রকোপ পুরোদমে বেড়েই চলেছে। এই জাতীয়তাবাদ বিশ্ব স্বাস্থ্যকে শুধু একটি ব্যবসা হিসেবেই দেখে। যখন কোনো দেশের সরকার অন্য দেশকে সুযোগ না দিয়ে নিজ দেশের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করে ফেলে, তখন এই প্রকোপ শুরু হয়। এর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, বিশ্বের ধনী দেশগুলো নিজ দেশের মানুষের জীবন নিয়েই শুধু চিন্তা করে, অন্য দেশকে সাহায্য করা কিংবা অতিমারির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াই করার কোনো মনোভাব তাদের মধ্যে থাকে না। ফলে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে ধনী ও গরিব দেশগুলো মধ্যে নতুন ধরনের বৈষম্য।

অক্সফামের তথ্যানুযায়ী, আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশ, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, ম্যাকাও, জাপান, সুইজারল্যান্ড করোনা ভ্যাকসিনের অর্ধেকেরও বেশি ডোজ কেনার আগাম চুক্তি সেরে ফেলেছে। অথচ জনসংখ্যার বিচারে এই দেশগুলোতে পৃথিবীর মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষের বসবাস। গ্লোবাল নিউজের মতে, যুক্তরাজ্য একাই অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ৩০ মিলিয়ন ডোজ কেনার চুক্তি করেছে। ইউরোপের আরো চারটি দেশ ৪০০ মিলিয়ন ডোজ কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র অক্সফোর্ডের ৩০০ মিলিয়ন ও ফাইজারের ১০০ মিলিয়ন ডোজ কেনার চুক্তি করেছে। পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স জোট বলছে, ধনী দেশগুলো তাদের মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশ ভ্যাকসিন কিনে রেখেছে। অক্সফাম বলছে, ধনী দেশগুলোর এ আচরণের কারণে ২০২১ সালের মধ্যে ৬৭টি নিম্ন আয়ের দেশের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন পাবে না। এদিকে করোনার টিকা কার্যক্রমে সবার চেয়ে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে ইসরায়েল। বায়োনটেক-ফাইজারের টিকা দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেছে তারা ১৯ ডিসেম্বর থেকে। পাঁচ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। অর্থাৎ, ১৭ ভাগ জনগোষ্ঠীকে এরই মধ্যে টিকার আওতায় এনেছে ইসরায়েল, যা সবার চেয়ে বেশি।

ভ্যাকসিন কূটনীতির লড়াইয়ে নেমেছে যেসব দেশ: করোনাভাইরাসে সারা বিশ্ব ছেয়ে যাওয়ার পর তার প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন জোগাড়ের জন্য নানা দেশ এখন মরিয়া। এই টিকা তৈরির গবেষণা মূলত চলছে ধনী দেশগুলোতে। করোনার কার্যকর টিকা তৈরির পর এই দেশগুলো যে নিজের নাগরিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই টিকা সরবরাহ করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এসব ধনী দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। আর এই সঙ্কট খুলে দিয়েছে ভ্যাকসিন কূটনীতির দুয়ার। কোভিড-১৯'র গবেষণা ও উৎপাদনের সাথে জড়িত কিছু দেশ এই ভ্যাকসিনকে ব্যবহার করছে তাদের প্রভাব বিস্তার ও স্বার্থসিদ্ধির কাজে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য ১৯৪টি দেশে করোনার দুটি টিকার জন্য ১৫০০ কোটিরও বেশি ডোজের প্রয়োজন হবে। নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনার ২৭৩টি ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চললেও মোট ১২টি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গবেষণার তৃতীয় ধাপ পার হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ভ্যাকসিনের ৭০% থেকে ৯৫% কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেছে। এরই মধ্যে ছয়টি ভ্যাকসিনকে বিভিন্ন দেশের সরকার জনগণের ওপর ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছে। আর এসব ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার জন্য ধনী দেশগুলো অনেক আগে থেকেই আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: একক বাজার হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে বড় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন সরকার এরই মধ্যে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কেনার জন্য। অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ খবর দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অপারেশন ওয়ার্প স্পিড-এর আওতায় ৩০০ কোটি ডলার ব্যয়ে ভ্যাকসিন কেনার জন্য ছয়টি কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে।

রাশিয়া: ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রশ্নে অস্পষ্ট মার্কিন অবস্থান রাশিয়ার জন্য তৈরি করেছে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক নতুন সুযোগ। মস্কোর সরকার ঘোষণা করেছে, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ২০টি দেশ তাদের তৈরি স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের আগাম চালান চেয়েছে। সংবাদ সাময়িকী নিউ স্টেটসম্যানের এক খবরে বলা হয়েছে, রুশ সরকারের বিনিয়োগ সংস্থা, রাশান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের শত শত কোটি ডোজ বিক্রির জন্য এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সাথে ডজন খানেক চুক্তি করেছে।

চীন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় বিশ্ব সঙ্কট মোকাবেলায় এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের স্থানে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আপাত উদাসীনতায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করার পথে দ্রুত এগিয়ে এসেছে চীন। এই মহামারির সূত্রপাত চীন থেকে হয়েছে, তার জন্য গোড়ার দিকে যে দুর্নাম রটেছিল, বেইজিং সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় তা অনেকখানিই কমে গেছে। সাংহাই গবেষণাগারের চীনা বিজ্ঞানীরা সরকারের প্রায় বিনা অনুমতিতেই কোভিড-১৯'র জিন সিকোয়েন্স বিশ্বের কাছে প্রকাশ করেছে।

ভারত: গত বছর অগাস্ট মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যখন বাংলাদেশ সফরে যান তখন ঢাকার সাথে শীতল হতে থাকা সম্পর্কে তেজ আনার জন্য ঘোষণা করেছিলেন যে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেয়া হবে। ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেছিলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যখন ভ্যাকসিন উৎপাদিত হবে তখন প্রতিবেশী, বন্ধু-দেশ এবং অন্যান্যরাও এর অংশীদার হবে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মি. শ্রিংলার ঢাকা সফরের আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল। সেটা হলো চীনের প্রভাব বলয় থেকে বাংলাদেশকে বাইরে রাখা। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। পাশে ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাস। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ হিসেব প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলংকা এবং আফগানিস্তানকেও ভারত অগ্রাধিকার দেবে বলে ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে দিল্লিতে দায়িত্বরত ৬৪ জন বিদেশি কূটনীতিক হায়দ্রাবাদে দুটি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানি-বায়োলজিক্যাল-ই এবং ভারত বায়োটেক ঘুরে এসেছেন। তবে দা প্রিন্ট নামে দিল্লি-ভিত্তিক খবরের ওয়েবসাইট সরকারি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, প্রতিবেশীদের কাছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহের কাজে ভারত ‘তাড়াহুড়ো’ করবে না।

অস্ট্রেলিয়অ: প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিবার’ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীরা যাতে দ্রুত করোনা ভ্যাকসিন পায় তার জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

জাপান: চীনের ‘হেলথ সিল্ক রোড’ কূটনীতি প্রতিবেশী জাপানকেও ভাবিয়ে তুলেছে। ব্যবসা সংক্রান্ত ওয়েবসাইট নিকে এশিয়ার খবর অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা প্রভাব ঠেকাতে টোকিওর সরকার গত অগাস্ট মাসেই একশো কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। মেকং নদীর তীরবর্তী পাঁচটি দেশ এই অর্থ পাবে।

https://dailysangram.com/post/450200