১৯ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ৩:৪০

ভ্যাকসিন দিতে পারছে না সেরাম

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে ভারতে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। কোভিড-১৯ মহামারি থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিনই এখন বড় অবলম্বন। ভ্যাকসিন গ্রহণে আগ্রহ বেড়েছে ভারতের জনগণের। এ চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বে ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন রপ্তানি আগেই বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। কবে নাগাদ তা চালু হবে সে বিষয়েও কিছু বলা হচ্ছে না। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলছে সেরামের উৎপাদিত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি এ ভ্যাকসিন সেরাম থেকে কিনে আনছে। এ ছাড়া কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যে ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা তারও বড় অংশ আসবে এই সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে। সামনে কবে ভ্যাকসিনের পরবর্তী চালান পাওয়া যাবে এটি এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সরকার ইতিমধ্যে তিন কোটি ডোজের চুক্তি করে অগ্রিম অর্থও জমা দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় চুক্তির ভ্যাকসিন সেরাম কবে দেবে তার নিশ্চিত কোনো তথ্য মিলছে না।

এদিকে বাংলাদেশে ফুরিয়ে আসছে ভ্যাকসিনের মজুত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৭১ লাখ ১৯ হাজার ১ ডোজ ভ্যাকসিন বিতরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৭ লাখ ১৪ হাজার ৯০ জন প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছে। আর দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেছেন ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৯ জন। ঢাকাসহ সারা দেশে ১ হাজার ১৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। যেহেতু ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রদানের পাশাপাশি প্রথম ডোজ প্রদানও অব্যাহত রয়েছে। তাই দ্রুত ভ্যাকসিনের নতুন চালান না আসলে নিবন্ধিত সকলের প্রথম ডোজ গ্রহণের আগেই ভ্যাকসিনের মজুত শেষ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিমাসে ভ্যাকসিনের ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা। সে অনুযায়ী ছয় মাসে তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ দেশে এলেও বিপুল চাহিদা আর বিশ্বজুড়ে টিকার সরবরাহ সংকটের মধ্যে ফেব্রুয়ারির চালানে বাংলাদেশ ২০ লাখ ডোজ হাতে পায়। এ ছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দুই দফায় ৩২ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে টিকা এসেছে এক কোটি দুই লাখ ডোজ। কিন্তু ভারত সরকার নিজেদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেয়ায় গত দুই মাসে ভ্যাকসিনের কোনো সরকারি চালান আর আসেনি। দেশে এ পর্যন্ত ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য নিবন্ধন করেছেন। বর্তমানে যে হারে ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে মজুত শেষ হয়ে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘ভ্যাকসিন ডিপ্লয়মেন্ট কমিটি’র প্রধান অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী টিকা কেনার জন্য হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারত আমাদের আশ্বাস দিয়েছে তারা সময়মতো ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে। আমরা এটা বিশ্বাস করি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভ্যাকসিনের বিকল্প উৎসের অনুসন্ধানে সরকার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। সমপ্রতি গাভি (জিএভিআই), ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের কাছ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিশ্চিত হয়েছে যে কোভাক্স ভ্যাকসিনের ২ কোটি ডোজ এপ্রিলের পরিবর্তে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আসতে পারে। তবে এ সরবরাহ ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা অপসারণের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের কোনো বিকল্প হাতে নেই বাংলাদেশের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন জটিলতায় চীন ও রাশিয়ার উৎপাদিত টিকার ট্রায়াল শুরু হয়নি। অন্যদিকে একটি দেশীয় কোম্পানি প্রথম ফেজের ট্রায়ালের অনুমতি পেলেও তারা ট্রায়াল শুরু করতে পারেনি।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনকারী দেশ ভারত। কিন্তু করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে পরিস্থিতি বিপর্যস্ত। এ সময়ে সেখানেই লাখ লাখ মানুষ টিকার জন্য অপেক্ষা করছে। ভারতের গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ টিকা বিক্রি হয় তার শতকরা ৬০ ভাগের বেশি উৎপাদন করে ভারত। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। প্রতিষ্ঠানটির বিপুল উৎপাদন সক্ষমতা থাকায় জাতিসংঘের কর্মসূচি কোভ্যাক্সে একটি বড় অবদান রাখে ভারত। কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে কম মূল্যে বা বিনামূল্যে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে। গত বছর প্রাথমিক চুক্তির অধীনে ৯২টি দেশের জন্য ২০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করার কথা সেরাম ইনস্টিটিউটের। কিন্তু মার্চে সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে পরিস্থিতি দ্রুতই প্রথম দফা সংক্রমণকে অতিক্রম করে যায়। এখানে গত বছর সেপ্টেম্বরে এক দিনে সংক্রমিত হয়েছিলেন কমপক্ষে ৯৭ হাজার মানুষ। সেটা ছিল প্রথম দফা সংক্রমণের পিক সময়। কিন্তু সে অবস্থাকে এবার অতিক্রম করে গেছে অনেক আগেই। গতকাল ভারতে একদিনে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন কমপক্ষে ২ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ মানুষ। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এটাই এ যাবৎকালের মধ্যে ভারতে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড। এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে সেখানে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার এবং এসআইআই সম্মিলিতভাবে কোভ্যাক্সিন কার্যক্রমে টিকা সরবরাহ দেয়ার চেয়ে নিজের দেশে নিজের নাগরিকদের টিকা সরবরাহকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কোভ্যাক্স কার্যক্রম পরিচালনার জোটে আছে আন্তর্জাতিক টিকা বিষয়ক সংগঠন গাভি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২৫শে মার্চ কোভ্যাক্স এক বিবৃতিতে বলেছে, মার্চ এবং এপ্রিলের টিকা সরবরাহ বিলম্বিত করবে এসআইআই। ভারতে করোনাভাইরাসের টিকার চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই বিলম্ব করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত কোভ্যাক্সে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ২ কোটি ৮০ লাখ ডোজ সরবরাহ দিয়েছে ভারত। মার্চে আরো ৪ কোটি ডোজ সরবরাহ দেয়ার কথা ছিল। এপ্রিলে দেয়ার কথা ছিল ৫ কোটি ডোজ। এ নিয়ে ভারত সরকার এবং কোভ্যাক্স আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এবারই প্রথম কোভ্যাক্সে টিকা সরবরাহ স্থগিত করেনি ভারত। জানুয়ারিতে সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল ভারত সরকার। সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আধার পুনাওয়ালা বলেছিলেন, তারা ভারতে আগে সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে চান। এজন্য এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ওড়িশাতে টিকা সংকটের কারণে গত সপ্তাহে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রায় ৭০০ টিকাদান কেন্দ্র। ওড়িশার স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে এ কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে যে, রাজ্যের মজুতে যে পরিমাণ টিকা আছে তা খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যেতে পারে। গত সপ্তাহে পাঞ্জাবের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রাজেশ ভাস্কর সিএনএন’কে বলেছেন, ওই রাজ্যে কোভিশিল্ডের ৪ লাখ ৫০ হাজার এবং কোভ্যাক্সিনের ৩০ হাজার ডোজ টিকা ছিল। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই রাজ্যে বসবাস করেন কমপক্ষে ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। মহারাষ্ট্রে বেশকিছু জেলায় অস্থায়ী ভিত্তিতে টিকাদান বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এরমধ্যে শুধু মুম্বইতে গত সপ্তাহে বন্ধ করা হয়েছে কমপক্ষে ৭০টি টিকাদান কেন্দ্র।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন সংকট কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ না। সমগ্র বিশ্বই বর্তমানে ভ্যাকসিনের মধ্যে করোনাভাইরাস সমস্যার সমাধান খুঁজছে। ফলে বাংলাদেশকে এখন রাশিয়া এবং চীনের মতো ভ্যাকসিনের বিকল্প উৎসের দিকে নজর দিচ্ছে। তাছাড়া ভ্যাকসিনের বিকল্প উৎসের অনুসন্ধান আরো গুরুত্ব পেয়েছে কেননা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সমপ্রতি জিএভিআই, ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের কাছ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে যে কোভাক্স ভ্যাকসিনের ২ কোটি ডোজ এপ্রিলের পরিবর্তে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আসতে পারে। তবে এ সরবরাহ ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা অপসারণের ওপর নির্ভরশীল।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=270757&cat=2