দেশে করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ চলমান। সামগ্রিকভাবে এ রোগের তীব্রতা বেড়েছে। এ সময়ে প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় প্রতিদিনের মৃত্যু সংখ্যা ও গড় মৃত্যু হার ঊর্ধ্বমুখী।
গত বছরের সর্বোচ্চ হারের চেয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে নারীর মৃত্যু হারও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, করোনা আক্রান্তদের মানসিক রোগও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে শুরু করেছে।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। শনিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের মার্চে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৩৮ জনের।
আর ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৯৪১ জনের। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই দুই মাসে মৃত্যু বেড়েছে ৩২ দশমিক ২ শতাংশ।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বেই।
বিশেষ করে যাদের বয়স বেশি, হার্টের রোগ রয়েছে, উচ্চরক্ত চাপ রয়েছে, ডায়াবেটিস আক্রান্ত অথবা অন্য জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, এ অবস্থার উত্তরণে রোগের প্রকোপ ও রোগী কমাতে হবে।
এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। সঠিক নিয়মে মাস্ক পরিধান করা, নিয়মিত হাত পরিষ্কার রাখা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
পাশাপাশি ৪০ বছরের উপরের বয়সি সবার টিকা নিশ্চিত করতে হবে। টিকা করোনাভাইরাস থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলের সঙ্গে এ বছরের একই সময়ের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করে আইইডিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনা আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি।
মার্চে পাঁচজন এবং এপ্রিলে মৃত্যু হয় ১৬৩ জনের। অন্যদিকে চলতি বছরের এ তিন মাসেই মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে ২৮১, ৬৩৮ এবং ৯৪১ জনের।
২৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আইইডিসিআর বলছে, এ সময় আক্রান্তদের ৪৪ শতাংশই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ৩৩ শতাংশ রোগী প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে, ১৭ শতাংশ বাড়িতে এবং ৬ শতাংশ অন্যান্য উপায়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের ৫২ শতাংশই উপসর্গ শুরুর ৫ দিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৬ শতাংশ ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এবং ১২ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হন উপসর্গ শুরুর ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪৮ শতাংশের এবং ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৬ শতাংশ রোগীর।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের জুলাইয়ে যখন কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট মৃত্যুহার সর্বোচ্চ ছিল, সে সময় নারী-পুরুষের মৃত্যু হার ছিল যথাক্রমে ১ অনুপাত ৩ দশমিক ৫।
এ বছর এপ্রিলে এসে দেখা যাচ্ছে নারী-পুরুষের মৃত্যুর অনুপাত ১ অনুপাত ২ দশমিক ২৩। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় নারীদের মৃত্যুহারও বেড়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত আগস্টে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৯১৬ পুরুষের মৃত্যু হয় অন্যদিকে নারীর মৃত্যু হয় ২৪৫ জন।
একইভাবে সেপ্টেম্বরে পুরুষ ৬৯৬ এবং নারী ২৭৩ জন, অক্টোবরে পুরুষ ৪৯০ ও নারী ১৭৪ জন, নভেম্বরে পুরুষ ৬৬৫ নারী ২৬০ জন, জানুয়ারিতে পুরুষ ৪৩০ এবং নারী ১৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে নারী ৪৪৫ এবং পুরুষ ১৪০ জন, মার্চে পুরুষ ৪৪৩ এবং নারী ২৮৩ জন এবং এপ্রিলে পুরুষ ৬১৪ এবং নারী ২৬৩ জন।
আইইডিসিআরের প্রতিবেদনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, ২০১৮ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
এর মধ্যে ৬ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা এবং ৪ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ভুগছেন দুশ্চিন্তায়। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে।
অর্থাৎ সাধারণ সময়ে চেয়ে কোভিড কালে মানসিক সমস্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্ট্রেস, বার্নআউট হচ্ছে। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আতঙ্ক মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
তাই মানসিক চাপ হ্রাস করতে হবে। অতিরিক্ত আতঙ্ক, অস্থিরতা, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, ঘুমের ধরন পরিবর্তন ও আচরণগত পরিবর্তন দেখা গেলে অবশ্যই কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
গত ৩ দিন ধরে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১০০-এর নিচে নামছে না। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৮৫ জন। পাশাপাশি দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্ত হয়েছেন ৭ লাখ ১৮ হাজার ৯৫০ জন। আর সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৩৬ জন।