১৮ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ১১:০৩

খরতাপ আর শিলাবৃষ্টির শঙ্কায় বোরো ধান কাটা শুরু

দেশের হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। অন্যান্য জায়গার ধানের কোথাও ফুল আসছে, কোথাওবা আবার ধান পাকা ধরছে। চলতি এপ্রিল মাসের শেষ অথবা মে মাসের শুরু দিকে পুরোদমে শুরু হবে বোরো ধান কাটা। এবার ধানের আবাদ খুব ভালো হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে প্রায় ৭৮ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। কিন্তু এরপরও কৃষকের মনে শান্তি নেই। ঠিকমতো ঘরে ফসল ওঠানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। এক দিকে খরতাপ, অন্য দিকে শিলাবৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা চিন্তায় ফেলেছে বোরো চাষিদের।

চলতি বছর ৪৮ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বিপরীতে এবার আবাদ হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ বেশি হয়েছে। গত ১ এপ্রিল থেকে হাওরাঞ্চল তথা সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের আস্তনা গ্রামে হাইব্রিড জাতের বোরো ধান কাটার উদ্বোধন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক। গত বছরের তুলনায় এবার ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে বেশি বোরো আবাদ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সারা দেশের বোরো ধান সফলভাবে ঘরে তুলতে পারলে করোনাকালেও দেশে খাদ্য নিয়ে ঝুঁকি থাকবে না। এবার কমপক্ষে তিন লাখ টন উৎপাদন বাড়বে। আর বোরো ধান বাজারে এলে চালের দামও স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জানান কৃষিমন্ত্রী। কিন্তু, গত ৪ এপ্রিল হাওরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বয়ে যাওয়া গরম বাতাস ও ঝড়ো হাওয়ায় প্রায় অর্ধ লাখ হেক্টর জমির (কোথাও পুরোপুরি, কোথাও আংশিক) বোরো ধান চিটা হয়ে যাওয়া এবং এর পরে আরো কয়েকটি এলাকায় কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়ায় চাষিদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবাদ ভালো হলেও ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলা নিয়েই এই শঙ্কা কৃষকদের। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ৩৫ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা হলেই হিটশক অর্থাৎ খরতাপে ধানের ক্ষেত পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

গত ৪ এপ্রিল রাতে যেটা দেশের হাওরাঞ্চল নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় হয়েছে। এরপর দেশের বেশ কিছু এলাকায় বৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টির মতো দুর্যোগে শত শত হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির কাছাকাছিই রয়েছে। ধানক্ষেতের তাপমাত্রা কমাতে জমিতে পানি দেয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে কোনো কোনো এলাকায় ক্ষেতে পানি রাখাও সম্ভব হচ্ছে না।

জানা যায়, ৪ এপ্রিল সন্ধ্যার পর সারা দেশের মতো কালবৈশাখীর ঝড়ো বাতাস শুরু হয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতেও। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে বাতাস ছিল অতিরিক্ত গরম। দেশের অধিকাংশ এলাকায় এরপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত সেসব এলাকায় বৃষ্টি হয়নি। পরদিন ৫ এপ্রিল সকালে ক্ষেতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ে কৃষকের। সূর্যের প্রখরতা যত বেড়েছে, ততই বোরো ধানের শীষ মরতে শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকায় একই ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি কী ঘটেছে তা নিয়ে পরিষ্কার ছিলেন না কৃষকরা।

হিটশক দেশে নতুন নয় উল্লেখ করে গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে আমরা হিটশকের তথ্য রেখেছি। এ পর্যন্ত যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে এর আগে হিটশক হয়েছে। তবে কখনো গ্রামের এক-দুইটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। এত বড় হিটশক এটাই প্রথম।’

সম্প্রতি কথা হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীরের সাথে। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, ৪ এপ্রিল তাপদাহে ৪৮ হাজার হেক্টর জমি এফেক্টেড হয়েছে। এটা বিভিন্ন লেভেলে। কোনো কোনো জমি ৮০ শতাংশ পর্যন্ত, কোনো জমি ৩০-৪০ শতাংশ বা এর কম বেশি। ৫-১০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে এমন জমিও রয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এসব ধানের জমিতে এখন পানি ধরে রাখা খুবই জরুরি। কিন্তু, বৃষ্টি না হওয়ায় খুব সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে। কারণ, এই এলাকায় খাল-বিল বা ডোবা থেকেই পানি সেচ দেয়া হয়। কোনো নলকূপ নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়। ড. শাহজাহান কবীর বলেন, বোরো ধানের যে সব জাত ফুল ফোটার পর্যায়ে আছে বা এখন ফুল ফুটছে বা সামনে ফুল ফুটবে, সে সব জমিতে পানি ধরে রেখে ধানের ফুল ফোটা পর্যায়ে হিট শক/ হিট ইনজুরি থেকে রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, বাকিটা বাঁচানোর জন্য এ উদ্যোগ নিতে হবে। পানি ধরে রাখতে হবেÑ এটাই আমাদের সাজেশন।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জমিতে অন্তত ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখার জন্য বলা হয়েছে। যাতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও পানি থাকলে তা কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যদি তাপমাত্রা রাখা যায়, তাহলে এ সমস্যা হবে না। যেখানে ঝড় হয়েছে, সেখানে পাতাপোড়া রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, সেখানে ৬০ গ্রাম এমওপি সার, ৬০ গ্রাম থিওভিট ও ২০ গ্রাম জিংক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকেলে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ব্রির মহাপরিচালক বলেন, ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ সেখানে উল্লেখ থাকবে, সেই অনুযায়ী সরকার সহযোগিতা করবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এবার ৪৮ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের টার্গেট ছিল। আবাদ হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ বেশি হয়েছে। সুতরাং এই ক্ষতি সামগ্রিকভাবে জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তায় কোনো প্রভাব পড়বে না। গতবারের চেয়ে এবার ফলন আরো ভালো হবে আশা করি। কিন্তু যেসব কৃষকের ক্ষতি হলো এটাই বিষয়। আর যদি কোনো দুর্যোগ না হয়, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।

৩২৮ কোটি টাকার ক্ষতি, ক্ষতিগ্রস্ত ৩ লাখ ৪ হাজার বোরো চাষি : গত ৪ এপ্রিল তাপদাহে হাওরাঞ্চলসহ মোট ৩৬টি জেলার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র গতকাল রাতে জানিয়েছে, হিটশকে মোট ৬৮ হাজার ১২৩ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষেত আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১০ হাজার ২৯৮ হেক্টর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরো ১১ হাজার হেক্টর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত জমিকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ততে কনভার্ট করে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২৯২ হেক্টর। উৎপাদনের হিসাবে ক্ষতি প্রায় ৯৬ হাজার টন ধান। যার আর্থিক পরিমাণ ৩২৮ কোটি টাকা। প্রায় ৩ লাখ ৪ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোরো ধান ছাড়াও ভুট্টা, সবজিসহ অন্য কয়েকটি ফসলেরও কিছু ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ২১ হাজার ৫৮৪ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন (৯৯ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন)। আর্থিক পরিমাণ ৩৩৪ কোটি ৪৪ লাখেরও বেশি টাকা। মোট ৩ লাখ ১০ হাজার কৃষক এই ক্ষতির শিকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ক্ষতির সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যান জানতে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/576364