১৮ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ১১:০১

রাজধানীর উত্তরা লেক উন্নয়ন কাজ ৭ বছরেও শেষ হয়নি॥ ব্যয় বেড়েছে দেড়শ শতাংশ

উত্তরা লেকটি আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ থেকে ৯ ও ১১ নম্বর সেক্টর হয়ে ৭, ১৩, ১৪, ৩ ও ৫ নম্বর সেক্টর পেরিয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তরা লেক রক্ষা, শরীরচর্চা, চিত্তবিনোদনের সুযোগসহ দৃষ্টিনন্দনভাবে উত্তরা লেকটি উন্নয়নের কাজ হাতে নিয়ে ছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কিন্তু ৭ বছর আগে ২০১৪ সালে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি বরং দফায় দফায় ব্যয় বেড়ে দেড়শ শতাংশে পৌঁছেছে। নানা কারণে আবারও ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ছে উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের। এবার ব্যয় বাড়ছে ১৫৪ শতাংশ আর কয়েক ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে ৮ বছর। মূল অনুমোদিত প্রকল্পে মোট ব্যয় ছিল ৩৭ কোটি ৩২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। এবার প্রথম সংশোধিত প্রকল্পে ৫৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। মোট প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৯৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকায়। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, খনন, বর্জ্য অপসারণ ও তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে নতুন প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে। নতুন এই প্রকল্পের আওতায় লেকের দুই পাশে ৮ ফুট চওড়া হাঁটার পথ, চারটি জায়গায় ঝুলন্ত হাঁটা পথ, একটি পদচারীসেতু, দুটি বড় সেতু, একটি কালভার্ট, ছয়টি গণশৌচাগার, ২২টি ওয়াটার ডেক (পানির ওপর ঝুলন্ত বসার জায়গা), ১২টি হ্যাংগিং ডেক (আংশিক পানির ওপর ঝুলন্ত বসার জায়গা), দুটি ব্যায়ামের স্থান, চারটি ঝরনা, খাওয়ার পানির ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক আরও কিছু কাজ করা হবে। এ ছাড়া ১৩ নম্বর সেক্টর পার্কের পাশে লেকের ওপর হাতিরঝিলের আদলে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ বানানো হবে। এখানে উত্তরার বাসিন্দারা অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ পাবেন। লেকটি উত্তরা ৩ ও ৫ নম্বর সেক্টর থেকে শুরু হয়ে সোনারগাঁ জনপথ সড়ক ধরে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের সামনে পর্যন্ত বিস্তৃত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ কিলোমিটার, প্রস্থ গড়ে ১০০ মিটার। এ প্রকল্পে লেক ঘেঁষে গড়ে ওঠা উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের পার্কটিও সংস্কার করার কথা। মূল প্রকল্পটি জুলাই ২০১৪ থেকে জুন ২০১৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা। এর পরে জুন ২০১৯ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। তারপরও প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না হওয়ায় জুন ২০২০ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়। জুন ২০২০ পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, বাস্তব অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য জুন ২০২৩ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। ফলে ধাপে ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮ বছর।

রাজউকের প্রস্তাব নিয়ে লকডাউনের পরে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা করবে পরিকল্পনা কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ উইং-১ এর উপপ্রধান দেবোত্তম সান্যাল গণমাধ্যমকে বলেন, প্রকল্পের প্রস্তাবনা রাজউজ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। লকডাউনের পরে পিইসি সভা হবে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে। এরপরই মূলত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অন্যদিকে রাজউক জানায় নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পর মাস্টার প্ল্যান, জরিপ এবং বাস্তব প্রয়োজনের ফলে লেকের পানি পরিচ্ছন্নকরণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, মাটি ভরাট ও তীর সংরক্ষণ কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া স্লাজ অপসারণ, অফিস ইকুইপমেন্ট, ইন্সপেকশন পিট নির্মাণ, পরিবেশগত সমীক্ষা, অফিস ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পরামর্শক ব্যয়, ওয়াকওয়ে ও নানা স্থাপনা মেরামত ও সংরক্ষণের পরিমাণ ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তব প্রয়োজনের নিরিখে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ক্যাচ পিট নির্মাণ এবং ওয়েস্ট বিন স্থাপন কাজ যুক্ত হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে সেতু নির্মাণ, বক্স কালভার্ট নির্মাণ, আরবরিকালচার, যানবাহন, বিদ্যমান কালভার্ট পুনর্বাসন এবং ডিওয়াটারিং অঙ্গা বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হলো ভূমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ১ দশমিক ২০ একর; ওয়াকওয়ে নির্মাণ ৪ হাজার ১৭০ মিটার, মাটি ভরাট কাজ ৬২ হাজার ঘনমিটার; তীর সংরক্ষণ কাজ সাড়ে ২৮ হাজার মিটার। স্লাজ অপসারণ ২ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার।

প্রকল্পের আওতায় ৯০০ মিটার আইসিসি পাইপ স্থাপন, ১২৭টি ইন্সপেকশন পিট নির্মাণ করা হবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় গ্রাস টার্ফিং ক্যাচপিট, লেকের পানি পরিচ্ছন্ন, ওয়েস্ট বিন স্থাপন, ওয়াল ও বিদ্যুৎতায়নের কাজ করা হবে। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য লেকগুলো বেদখল থেকে রক্ষা করা; লেকের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ কাজ; প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে মহানগরীর নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা; লেকের চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে পথচারীদের হাঁটার সুযোগ তৈরি করা; ব্রিজ নির্মাণের মাধ্যমে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধন করা; ডাইভারশন ড্রেনেজের মাধ্যমে লেকের দূষণ প্রতিরোধকরণ ও লেকের পানির গুণগত মানের উন্নতিকরণ এবং চিত্তবিনোদন সুবিধার উন্নয়ন করা।

উত্তরা আবাসিক আদর্শ শহর শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পর্যায়ক্রমে প্রকল্পের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব গ্রহণ করে রাজউক। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব বাস্তবায়নের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় পানি ধারণ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং পানির গুণগত মানেরও অবনতি ঘটে। উত্তরা আবাসিক মডেল টাউনের ৯৫ শতাংশ এলাকাতেই এখন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এখানে প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ লোকের বাস। কিন্তু উত্তরা লেক ছাড়া আর কোনো জলাধার এখানে নেই। আশপাশের নদীর সঙ্গে লেকের সংযোগও যথেষ্ট সচল নয়। ফলে অতিবৃষ্টি হলেই এখানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তাছাড়া লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো কোনো অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাও নেই। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জুলাই ২০১৪ থেকে জুন ২০১৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে বা ৭ বছর আগে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

রাজউকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লেকের দুই পাড়েই হবে দৃষ্টিনন্দন পায়ে হাঁটার পথ। ৩ নম্বর সেক্টরের সেতু ও গাউসুল আজম অ্যাভিনিউয়ের সেতু ভেঙে উঁচু সেতু বানানো হবে। সোনারগাঁ জনপথ অংশে হবে বড় কালভার্ট। এসবের নিচ দিয়ে ওয়াটার ট্যাক্সি চলার ব্যবস্থা থাকবে। পাড় দিয়ে হাঁটার পাশাপাশি পানিপথেও আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। উঁচু সেতুর কারণে যানবাহনও চলতে পারবে যানজট ছাড়া। পানিতে দুর্গন্ধ, ভরাট হয়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে ২০১৩ সালে লেকটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় রাজউক। প্রাথমিকভাবে লেকের এক কিলোমিটার অংশ (৩, ৫ ও ৭ নম্বর সেক্টরের অংশ) খনন, বর্জ্য অপসারণ ও তীর সংরক্ষণের জন্য ২০১৪ সালে একটি প্রকল্প নেয় রাজউক। প্রায় ৩৭ কোটি ৩২ লাখ টাকার এই প্রকল্প ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের কাজই শুরু হয় ২০১৭ সালের শেষ দিকে। এখন প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু তাও শেষ করা সম্ভব হয়নি প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য জুন ২০২৩ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। ফলে ধাপে ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮ বছর।

দেরিতে কাজ শুরুর কারণ সম্পর্কে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, প্রকল্প পাস হলেও উত্তরার লেক নিয়ে কোনো মাস্টারপ্ল্যান ছিল না। ২০১৬-১৭ সালে উত্তরা লেক নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। মাস্টারপ্ল্যান হওয়ার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে লেকের এক কিলোমিটার অংশের খনন, বর্জ্য অপসারণ ও তীর সংরক্ষণের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় লেক সংস্কারের জন্য প্রায় এক একর জায়গা অধিগ্রহণ করতে চাইছে রাজউক। এই জায়গার মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় জমির জন্য জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জমি হস্তান্তরের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তার উত্তর পাওয়া যায়নি।

এই প্রকল্পের পরিচালক আমিনুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রকল্পটির কাজ চলাকালীন মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী উত্তরা লেক সংস্কারের জন্য সংশোধিত একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল। যাতে সংশোধিত প্রকল্প অনুযায়ী পুরো সংস্কারকাজ একবারেই শেষ করা যায়। তবে মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে আরেকটি উন্নয়ন পরিকল্পনা জমা দিতে বলা হয়েছে। সেটির কাজ চলছে। শিগগিরই নতুন পরিকল্পনা জমা দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে লেকের পানি ধারণক্ষমতা বাড়বে, পানির গুণগত মান বাড়বে, পথচারীরা লেকের পাড়ে হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি ওয়াটার ট্যাক্সির মাধ্যমে চলাচলের সুযোগ পাবে। কাজ শেষ করার পর এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব উত্তরার সেক্টরভিত্তিক কল্যাণ সমিতিকে দেওয়া হবে; যাতে লেক নোংরা না হয় ও ব্যবহারকারীরাই লেকটির সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে পারেন। তবে প্রয়োজন হলে রাজউক সংস্কার করে দেবে। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উত্তরার চেহারাই পাল্টে যাবে। হাতিরঝিলের মতো শুধু লেক দেখার জন্যও অনেকেই সেখানে ঘুরতে যাবেন।

এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, উত্তরা লেক উন্নয়নে প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় লেকের সংস্কার শুরু হয়েছে। তিন অংশে বিভক্ত এ লেকের দক্ষিণ অংশের উন্নয়ন কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে শিগগির সৌন্দর্য বর্ধন করে আবারও এলাকাবাসীর অবসর যাপনের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে লেক ও লেকপাড়।

৫ নং সেক্টরের বাসিন্দা কবির হাসান বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও লেকটির সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় আমরা খুশি। তিনি বর্তমান সরকারকেও ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আশা করি যথাসময়ে লেকের সংস্কার কাজ শেষ হবে। ৩ নং সেক্টরের বাসিন্দা রাশেদা আক্তার সোনিয়া জানান, একসময় এ লেকের পাড়ে বিকেলে হাঁটতাম ও সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। মাঝে অনেক বছর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ হওয়ায় লেকপাড়ে যাওয়া ছেড়ে দেই।

https://dailysangram.com/post/449963