ধামরাই থেকে গতকাল চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন মতিলাল সরকার। হাসপাতাল এলাকায় এখন রোগী ও স্বজনদের এমনই হাহাকার। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
১৭ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ৩:২১

‘বেড খালি নেই’

জেলায় সুবিধা না থাকায় ঢাকার হাসপাতালে চাপ

চিকিৎসকের পরামর্শে বাবার জন্য একটি আইসিইউ বেড চেয়ে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চার দিন আগে আবেদন করে রেখেছেন রায়হানুল হক। প্রতিদিনই খোঁজ নিচ্ছেন আর প্রতিদিনই শুনছেন একই কথা—‘খালি হয়নি, হলে পাবেন।’ রায়হান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি প্রাইভেট হাসপাতালের এইচডিইউতে রেখে চিকিৎসা চলছে বাবার; অবস্থা প্রতিদিনই একটু একটু করে খারাপ হচ্ছে আর বিলও বেড়ে যাচ্ছে দৌড়ে। এখন যেখানে আছে সেখানেও আইসিইউ বেড খালি পাচ্ছি না, আরো তিনটি হাসপাতালে লিংক লাগিয়ে রেখেছি। কিন্তু বাবা বেঁচে থাকতে আর আইসিইউ পাব কি না বুঝতে পারছি না।’

মুগদা হাসপাতালে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, সেখানে আইসিইউতে বেড আছে ১৯টি, সব বেডই রোগীতে ভরা। সম্প্রতি আইসিইউয়ের কাছাকাছি প্রযুক্তিসম্পন্ন ৩৭টি হাইফ্লো ন্যাজল ক্যানুলাসংবলিত বেড বাড়ানো হয়েছে, সেই সঙ্গে আরো ২৫টি বেডকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অক্সিজেন জোগান দেওয়ার মতো অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সংযুক্ত করা হয়েছে, যার সবই ভরে গেছে; অর্থাৎ একটিও আইসিইউ বা আইসিইউ সমতুল্য বেড ওই হাসপাতালে খালি নেই। এমনকি এখানকার ৩১০টি জেনারেল বেডের মধ্যে কোনো মতে খালি আছে ৬৩টি।

মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা গত কয়েক দিন ধরে নতুন কোনো আবেদন নিতে পারছি না। পুরনো আবেদনও ধরার সুযোগ হচ্ছে না, কোনো তদবিরেও কান দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। কারণ আমাদের হাসপাতালে যারা ভর্তি আছে, তাদের ১০০ জনের বেশি রোগীর অবস্থা আইসিইউতে নেওয়ার মতো থাকে। প্রতিদিনই আরো কারো না কারো অবস্থা খারাপ হয়, ফলে আইসিইউ বেড একটি ফাঁকা হলেও ভেতরের রোগীদের থেকেই সেখানে স্থানান্তর করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, অন্য বেশির ভাগ হাসপাতালেও একই অবস্থা। তবে আইসিইউর চাপ কমাতে হলে প্রতিটি হাসপাতালে অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করা দরকার। নয়তো এখন যা অবস্থা তা চলতে থাকলে বা আরো খারাপ হলে রিফিল সিস্টিমে কুলানো যাবে না, আর সরকারেরও খরচ বেশি হচ্ছে। একেকটি হাসপাতালে প্রতিদিন মিনিটে লাখ লাখ লিটার অক্সিজেন লাগছে।

মুগদা হাসপাতালের মতোই অবস্থা রাজধানীর আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সেখানকার কভিড ইউনিটের ১০টি আইসিইউ বেড, ১৫টি হাইফ্লো ন্যাজল ক্যানুলাসংবলিত বেড ও ১৫টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সংযুক্ত বেডের একটিও খালি নেই। ফলে যাঁরাই ওই হাসপাতালে আইসিইউ বা সমতুল্য বেডের খোঁজে যান তাঁদের এক কথায় শুনতে হচ্ছে—‘খালি নেই’। এমনকি ওই হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসককেও ছুটতে হয়েছে অন্য হাসপাতালে। পাশাপাশি এখানকার ২৪০ জেনারেল বেডের মধ্যে খালি আছে মাত্র ৭২টি। তাও গত দুই দিন ধরে সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জেনারেল বেড ফাঁকা হতে শুরু করেছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইসিইউ খালি হলেই তা সঙ্গে সঙ্গে আবার পূরণ হয়ে যায়। এ ছাড়া আইসিইউতে যারা যায় তাদের অনেকটাই সময় লাগে। ফলে খালি হতেও সময় লাগে। আমরা দু-এক দিনের মধ্যেই ২০ বেডের একটি এইচডিইউ ইউনিট চালু করতে যাচ্ছি। আশা করি তখন কিছুটা সুবিধা হবে।’ তিনি আরো বলেন, জেনারেল বেডে কিছুটা মনে হচ্ছে চাপ কমতে শুরু করেছে ধীরগতিতে হলেও। আরো সপ্তাহখানেক পরে বোঝা যাবে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়।

এমনই দুর্বিষহ অবস্থা চলছে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে। সরকারি বা বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই একটি আইসিইউ বেড খালি নেই, জেনারেল বেডগুলোও রোগীতে ভরা। শুধু ঢাকায়ই নয়, ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা। যদিও কোথাও কোথাও এখনো রোগীর চাপ তুলনামূলক কম। ৬৪ জেলার মধ্যে ৩০টির বেশি জেলায় নেই সরকারি আইসিইউ সুবিধা, তবে বিভিন্ন জেলায় কিছু আইসিইউ বেডও খালি পড়ে আছে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় আইসিইউ না থাকায় সেখানকার রোগীদের নিয়ে ঢাকায় ছুটছে স্বজনরা। আবার কোথাও কোথাও আইসিইউ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম অথবা জনবলের অভাবে পরিত্যক্ত রয়েছে। ফলে ঢাকার হাসপাতালে বাড়ছে চাপ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি ৪৩টি হাসপাতালে মোট চার হাজার ৫৫৩টি জেনারেল বেডের মধ্যে খালি আছে ৯১২টি। আর এক হাজার ২১৭টি আইসিইউ ও সমতুল্য বেডের মধ্যে খালি আছে ৩০১টি। তবে খালি বেডের ভেতর পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ বেড নেই বললেই চলে; বেশির ভাগই হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যুক্ত বেড। অন্যদিকে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি কভিড হাসপাতাল বা ইউনিটগুলোতে জেনারেল বেড রয়েছে ১০ হাজার ৬৬১টি। গতকাল শুক্রবার সকালেও ভর্তি রোগী ছিল পাঁচ হাজার ৪১৯ জন বা ৫৪ শতাংশ বেড রোগীতে পূর্ণ ছিল এবং বাকি পাঁচ হাজার ২৪২টি বা ৪৬ শতাংশ বেড খালি ছিল। অন্যদিকে সারা দেশে মোট ৮২২টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ৬২৬টিতে বা ৭৯ শতাংশ রোগীতে ভরা এবং ২১ শতাংশ বা ১৯৬টি খালি ছিল।

ঢাকার বাইরে চাঁদপুরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার সুজাউদৌলা রুবেল বলেন, কারো কারো অবস্থা এতটাই জটিল থাকে যে এখানে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে আইসিইউ সাপোর্ট থাকলে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, চাঁদপুরে আইসিইউ নেই। ফলে অনেক করোনা রোগী যাদের মুমূর্ষু অবস্থা তাদের বাঁচানো যাচ্ছে না।

চাঁদপুর জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রথম ঢেউ শুরু হলে গত বছর এখানে ১০ শয্যাবিশিষ্ট একটি আইসিইউ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত এক বছরেও আর গতি পায়নি ওই উদ্যোগ।

চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান জানান, সদর হাসপাতালে চারটি আইসিইউ বেডের জন্য আরো আগেই প্রস্তাবনা পাঠানো আছে। এখন পর্যন্ত কোনো সন্তোষজনক খবর আসেনি।

নরসিংদীতেও এখনো জোটেনি আইসিইউ বেড। এক সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্কে জেলাবাসী। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের লোকজনের দাবি, নরসিংদীতে কোনো হাসপাতালে যদি আইসিইউর ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো তারা চিকিৎসার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করতে পারত।

হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নরসিংদীর ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালটিকে কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়। এখনো সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে নরসিংদী।

জেলা হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা ডা. এ এন এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে আইসিইউ, পিসিআর ল্যাব, সেন্ট্রাল অক্সিজেনের দরকার। এর মধ্যে নরসিংদীর শিল্পপতি মজিদ মোল্লা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মোল্লার অর্থায়ন, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিএমএর সহযোগিতায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে।’

এদিকে ঝালকাঠি, পঞ্চগড়, মাদারীপুর, পাবনা, লালমনিরহাট, মৌলভীবাজার, শেরপুর, ঝিনাইদহ, রাঙামাটি, লক্ষ্মীপুরসহ আরো ২০টির বেশি জেলায় এখনো আইসিইউ সুবিধা নেই বলে জানা গেছে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে। আবার জামালপুরসহ কয়েকটি জেলায় আইসিইউ থাকলেও তা চালানোর মতো জনবল না থাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ইউনিটটি।

অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকাসহ সারা দেশেই নতুন বেড ও আইসিইউ স্থাপনের কাজ চলছে। এ মাসের মধ্যেই হাসপাতালে জেনারেল ও আইসিইউ বেডসহ অন্যান্য সংকট অনেকাংশে কেটে যাবে বলে আশা করছি।’

তবে এত কিছুর মাঝেই আশার আলো হয়ে আসছে রাজধানীর মহাখালীতে ডিএনসিসির করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল। আগামীকাল রবিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই হাসপাতালটি উদ্বোধন শেষে রোগী ভর্তি করা শুরু হবে। এই হাসপাতালে দেশের সর্বোচ্চ ২১২টি আইসিইউ বেড, ৫০টি এইচডিইউ বেড, ৫০টি ইমার্জেন্সি অবজারভেশন বেড ও ৫৪০টি আইসোলেশন রুম থাকছে।

ওই হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি দেশের সবচেয়ে বড় করোনা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলছি। এরই মধ্যে সব কাজ প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে। এখানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সর্বোচ্চ সেবার সুযোগ রাখা হচ্ছে। যারা উপসর্গ নিয়ে আসবে তাদেরও রাখা হবে, যাদের আইসিইউ প্রয়োজন, তাদেরও রাখা হবে। সবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কালের কণ্ঠ’র চাঁদপুর, নরসিংদী, চুয়াডাঙ্গাসহ কয়েকটি এলাকার প্রতিনিধিরা।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/04/17/1024591