১৭ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ৩:১৩

ত্রুটিপূর্ণ উত্তরণ নীতি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে

বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মহামারি পরবর্তীকালে শক্তিশালী বিকাশ নিয়ে উত্তরণের প্রত্যাশা করছে। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তা বুঝাতে সক্ষম হয়েছে। তবে বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেই নিশ্চয়তা নেই। বরং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা পরবর্তী কালের তুলনায় উত্তরণের সম্ভাবনা অনেক বেশি ত্রুটিপূর্ণ হিসাবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। এমনটা হওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে সীমান্ত ভেদে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রণোদনা ও টিকা কর্মসূচির অসমতাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির সার্বিক পূর্বাভাসে উন্নতি আসলেও, সম্ভাবনাগুলো বিপজ্জনকভাবে বিচ্ছিন্নতায় রূপ নিচ্ছে। এখনও সব দেশের সকল মানুষের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিনিয়ত চাকরি হারাচ্ছেন এবং ক্রমবর্ধমান অতি-দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছেন। অনেক দেশ উত্তরণের পথ থেকে পিছিয়ে পড়ছে। করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাতে তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং রেমিটেন্স কমে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব ব্যাংক।

জানা গেছে, চলতি বছরেই গত অর্ধশতকের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। তবে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির মহামারির অভিঘাত উত্তরণের দিক থেকে যে পার্থক্য ও বৈষম্য রয়েছে তা মহামারি পূর্ব অবস্থানে বিশ্ব অর্থনীতির ফিরে আসাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি সেই সুদিনে ফেরাকে দীর্ঘমেয়াদী ও কষ্টসাধ্য করে তুলতে সক্ষম। ইতোমধ্যে জাতীয়সহ বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর অর্ধ-বার্ষিক বৈঠকে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের "আমেরিকা প্রথম" নীতিকে পরাজিত করে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব অর্থনীতির অভিভাবকের আসনে আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, সেজন্য তার প্রশাসন লাখ লাখ কোটি ডলারের বাজেট প্রণোদনা ঘোষণাও করেছে। সরকারি প্রণোদনার মধ্যেই গত আগস্টের পর সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সংবাদ জানা যায় চলতি মাসে। এতে নতুন আশা জেগেছে মার্কিন অর্থনীতিতে। অন্যদিকে চীনও নিজের বৈশ্বিক অবদান জোরদার রেখেছে। প্রথমে দেশটি সফলভাবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও তার প্রেক্ষিতে সুবিশাল অর্থনীতিকে সবার আগে গতিশীল করে চমক লাগায়। এখন দেশটি আন্তর্জাতিক পণ্য চাহিদার বড় অংশের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করছে। মহামারির প্রাথমিক দৈন্যদশার পর দেশটি পূর্ব ঘোষিত কিছু প্রণোদনা বাতিল করা শুরু করলেও, তাতে ইতোমধ্যেই প্রাণবন্ত অর্থনীতি তেমন প্রভাবিত হয়নি। অর্থাৎ, বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির এ দুই দেশ মহামারি পরবর্তীকালে শক্তিশালী বিকাশ নিয়ে উত্তরণের প্রত্যাশা করছে। বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।

তবে বাইডেন প্রশাসনের প্রণোদনা প্যাকেজকে “দ্বিধারী তলোয়ার” বলে মন্তব্য করেন আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মাওরি অবস্টফেল্ড। তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিটারসন ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সে সিনিয়র ফেলো হিসেবে যুক্ত আছেন। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি সুদহার বাড়তে থাকায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা সঙ্কুচিত হবে। একারণে মহামারির অভিঘাত মোকাবিলায় বিপুল ঋণ নেওয়া দেশগুলোর পক্ষে দেনার টেকসই ব্যবস্থাপনা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। একথার মাধ্যমে তিনি অন্যান্য দেশের সরকারের প্রণোদনা সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ার দিকেই ইঙ্গিত দেন, যা স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের পথ আরও কঠিন করবে।

এ বিষয়ে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানান, বৈশ্বিক অর্থনীতির সার্বিক পূর্বাভাসে উন্নতি আসলেও, সম্ভাবনাগুলো বিপজ্জনকভাবে বিচ্ছিন্নতায় রূপ নিচ্ছে। এখনও সব দেশের সকল মানুষের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিনিয়ত চাকরি হারাচ্ছেন এবং ক্রমবর্ধমান অতি-দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছেন। অনেক দেশ উত্তরণের পথ থেকে পিছিয়েও পড়ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো করে মহামারির ক্ষয়ক্ষতি সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের একটি বিশাল অংশের কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। এমনটা হলে, ২০২৪ সালে গড় বৈশ্বিক উৎপাদন হবে মহামারি পূর্বকালে দেওয়া আভাসের তুলনায় ৩ শতাংশ কম। আইএমএফ জানায়, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে পর্যটন এবং সেবা ভিত্তিক খাতের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো।

আবার চলতি ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী প্রান্তিকের তুলনায় ১.৩ শতাংশ অনুমান করা হয়েছে। তবে ওই একই আভাস সূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনর্জীবিত হওয়ার চিত্র উঠে আসলেও, জানানো হয় ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের অর্থনীতি ক্রমে সঙ্কুচিত হওয়ার কথা। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ব্রাজিল, রাশিয়া ও ভারত স্পষ্টতই পিছিয়ে পড়েছে চীনের গতির কাছে। অসম বিকাশের এই পার্থক্য ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স তাদের নতুনতম প্রাক্কালন সূচি "নাউকাস্ট" এর মাধ্যমে প্রকাশ করে।

চলতি বছরের পুরো সময়ে ৬.৯ শতাংশ বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির আভাস দিয়েছে ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স, যা ১৯৬০ সালের পর সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধির রেকর্ড। এই স্ফীত আভাসের আওতায় আমলে নেওয়া হয়; ভাইরাসের হুমকি হ্রাস, মার্কিন সরকারের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনার প্রভাব এবং জমানো সঞ্চয় থেকে ভোক্তাদের খরচের প্রবণতা। কিন্তু, আভাসটির বাস্তবায়ন নির্ভর করছে সকল দেশ কত দ্রুত অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে পারে তার ওপর। এতে যত বেশি সময় লাগবে, বিশ্ব অর্থনীতির ঘাড়ে ভাইরাসের হুমকি ততোই প্রলম্বিত হবে। তাছাড়া, অভিযোজনের কারণে নতুন ধরন সৃষ্টির ফলে ভাইরাসের হুমকি আন্তর্জাতিক সঙ্কটেও রূপ নিয়েছে। ব্লুমবার্গ ভ্যাকসিন ট্র্যাকার অনুসারে, নিজ জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র, সেই তুলনায় ইউরোপিয় ইউনিয়ন ১০ শতাংশ হারও অর্জন করতে পারেনি। মেক্সিকো, রাশিয়া এবং ব্রাজিলে তা ৬ শতাংশেরও কম। আর জাপানে সংখ্যাটি ১ শতাংশের চেয়েও কম।
এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাতে তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং রেমিটেন্স কমে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব ব্যাংক। বিশ্ব ব্যাংকের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক আউটলুকের’ জানুয়ারি সংখ্যায় এই ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক ও রেমিটেন্স। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা লেগেছে এই খাতে। আর রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশের মতো অবদান রাখে বিদেশে থাকা ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ । বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বো হয়েছে, মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাকের চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির জন্য বাহ্যিক উৎসের উপর নির্ভরশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হবে দুর্বল। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের কারণে বাংলাদেশে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দুর্বল থাকবে।

সংস্থাটি বলেছে, মহামারি থেকে দীর্ঘমেয়াদী পুনরুদ্ধারের অর্থনৈতিক পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাতের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে। এর ফলে দেউলিয়াত্ব বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের ব্যালান্স শিট দুর্বল হতে পারে। এছাড়া চরম আবহাওয়ার প্রভাবও আঞ্চলিক ঝুঁকি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, মহামারির কারণে গত বছর বিশ্ব অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত ৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে সঙ্কুচিত হয়েছে। তবে ২০২১ সালে তা ৪ শতাংশ হারে বাড়তে পারে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতি উত্তরণের ক্ষেত্রে যে অসমতা সে বিপজ্জনক অবস্থার দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মহামারির মধ্যেও চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সরকার। তবে বিশ্ব ব্যাংকের আভাস, এই প্রবৃদ্ধি এক দশমিক ৬ শতাংশ হবে।

এদিকে ২০২১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি অনুমান করে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ শীর্ষক পূর্বাভাস সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটন ভিত্তিক দাতা গোষ্ঠীটি। এবার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংস্থাটির বসন্তকালীন বৈঠকের পূর্বে আউটলুক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরেকটু শক্তিশালী হয়ে ৭.৫ শতাংশ হারে বাড়বে বলেও জানানো হয়। ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুই বড় অর্থনীতি ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে ১২.৫ ও ১.৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলেও জানায় আইএমএফ।

আইএমএফ-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ জানান, পূর্ব প্রকাশিত আভাস সংশোধন করে আমরা ২০২১ ও ২০২২ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির আরও শক্তিশালী উত্তরণের অনুমান করছি। যার আওতায় ২০২১ সালে ৬ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৪.৪ শতাংশ হারে বিশ্ব অর্থনীতি বাড়বে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছর ৭.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আইএমএফ জানিয়েছে। এছাড়া, ইউরো জোনে ৩.৩ এবং যুক্তরাজ্যে ৫.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আভাস দিয়েছে সংস্থাটি। তবে টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমতা আনতে না পারলে বিশ্ব অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

https://dailysangram.com/post/449861