১৭ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ৩:০৭

২০৫০ সালে বিশ্বে ৩য় শীর্ষ জনবহুল শহর হবে ঢাকা

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই শুমারিতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে তখন এই শহরের জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। প্রতিদিন বাড়ছে ঢাকার জনসংখ্যা। জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজধানী ঢাকায় জনদুর্ভোগ। রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকা, যেটাকে আমরা মেগাসিটি বলি। সেই ঢাকায় সরকারি হিসেবে জনসংখ্যা এখন ১ কোটি ৭০ লাখ। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) দেওয়া এই হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ১১তম। ২০৫০ সালে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে ঢাকার অবস্থান তৃতীয় স্থানে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হিসাবে এটিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘন শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। এটা ভীষণ উদ্বেগজনক তথ্য। সেই হিসেবে বলা যায়, আগামী ২০৫০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানাযায়, ২০৫০ সালে বিশ্বে ৩য় শীর্ষ জনবহুল শহর হবে ঢাকা। ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রতিদিন এক হাজার ৪১৮ জন মানুষ বাড়ছে। বছরে যুক্ত হচ্ছে গড়ে পাঁচ লাখ সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ। এই হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামী ৩০ বছর পর ঢাকায় জনসংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ জনবহুল শহর হবে ঢাকা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির মডেলগুলোর ওপর ভিত্তি করে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল সিটিস ইন্সটিটিউট’-এর করা নতুন এক তালিকায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই তালিকায় দেখা গেছে, তিন দশকের বেশি সময় পর বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর হবে ভারতের মুম্বাই। এরপর দ্বিতীয় স্থানে থাকবে একই দেশের দিল্লি। তারপরই থাকবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান। গ্লোবাল সিটিস ইন্সটিটিউট’-এর তালিকা অনুযায়ী শীর্ষ ১০ জনবহুল শহর হচ্ছে- মুম্বাই, দিল্লি, ঢাকা, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোর শহর কিনসাসা, কলকাতা, লাগোস, টোকিও, করাচি, নিউইয়র্ক, মেক্সিকো সিটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা আবাসন। ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে। অর্থাৎ প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ঘিঞ্জি পরিবেশে বাস করে। তাদের সুপেয় পানির সরবরাহ, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও গোসলের ব্যবস্থা নেই। কারণ, ঢাকা মেগাসিটির এই জনঘনত্ব অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক। পৃথিবীর আর কোনো অংশের কোনো জনপদের মানুষ কখনো এত ঘনবদ্ধ হয়ে বসবাস করার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি। ঢাকার পরে দ্বিতীয় জনঘন শহর যে মুম্বাই, সেটিও ঢাকার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩২ হাজার ৪০০ লোকের বাস, যা ঢাকার তুলনায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১ হাজার জন কম। এই অস্বাভাবিক মাত্রার জনঘনত্বের কারণে ঢাকা মেগাসিটির জীবনে কত রকমের সমস্যা কত জটিল আকার ধারণ করেছে, তার ফিরিস্তি নিষ্প্রয়োজন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, অস্বাভাবিক মাত্রায় জনঘনত্বপূর্ণ একটি মেগাসিটির রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে, কীভাবে সেবাব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা যাবে, এসব নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা নেই। শুধু যানজটের কারণেই যে শহরে জনজীবন প্রায় স্থবির হতে চলেছে, সেখানে প্রতিদিন যে আরও ১ হাজার ৭০০ মানুষ এসে যোগ দিচ্ছে, তাদের ঠেকানোরও কোনো উদ্যোগ নেই। কিন্তু এখনই উদ্যোগ নিতে হবে, নইলে এই মেগাসিটি আর কয়েক বছরের মধ্যেই সামগ্রিকভাবে ব্যবস্থাপনার অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে। কী করণীয়, তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন: বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং সেবাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বিভিন্ন আঞ্চলিক শহরে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে করে ঢাকার বাইরে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসার প্রয়োজন বোধ না করে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি বছর ঢাকা শহরে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়, যা দিনে এক হাজার ৭০০। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হবে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে তৃতীয় শীর্ষ জনবহু শহর হবে। এতো মানুষের আবাসন, কর্মসংস্থান সবই হয়েছে ঢাকায়। এতে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগরী। এখন সরকার ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তার সুফল পাচ্ছে না জনগণ। উল্টো নগরে যানজট, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যা বেড়েই চলছে। শুধু দেশের রাজধানী হওয়ার কারণে নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, চিকিৎসা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সব বিবেচনায় এই শহর তৈরি হয়েছে দেশের একক কেন্দ্র হিসেবে। সমগ্র দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে অব্যাহতভাবে কেন্দ্রমুখী উন্নয়নদর্শন একটি বিরাট সমস্যা, যা ঢাকামুখী গ্রামীণ মানুষের স্রোতকে অব্যাহত রেখেছে। শহরে এত মানুষকে ধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, পরিবহনব্যবস্থা, সামাজিক ও নাগরিক পরিষেবা ইত্যাদি চাহিদামাফিক তৈরি হয়নি। ১৯৫৯ সাল থেকে এই শহরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান থাকার পরও দুর্বল নগর পরিচালনের কারণে শহরের উন্নতি হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে।

নিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বর্তমানে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ বাস করছে। আর সারা দেশে জনসংখ্যা এখন ১৫ কোটি ৬২ লাখ। দেশে জনসংখ্যা বছরে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ হারে বাড়লেও শহর এলাকায় এই হার ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। তবে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী এই তিন প্রধান শহরে বর্তমানে যত মানুষ বাস করে, তার চেয়ে বেশি মানুষ গত ১৩ বছরে বেড়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায়। এই সংখ্যাটি ৬৭ লাখ। নগর গবেষকদের মতে, প্রতিদিন ঢাকায় ২ হাজার ১শ ৩৬ জন নতুন মুখ ঢাকায় ঢুকে পড়ছে। আর বছর শেষে মহানগরীতে যুক্ত হচ্ছে ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। যে হারে মানুষ বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাগরিক সুবিধা বাড়ছে না। এতে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যানজটের সমস্যা দিন দিন কেবল প্রকটই হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের সেরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকায়। সরকারি সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগের প্রধান কার্যালয়, বেসরকারি বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানও এই শহরে। প্রধান প্রধান ও বিশেষায়িত সব হাসপাতাল এখানে। ব্যাংক-বীমাসহ সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকায়। বিদেশি সব দূতাবাস এখানে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহন সাত লাখ ৯৭ হাজার ১৮৪টি। প্রতিদিন রাস্তায় নামছে ১৮০টি নতুন যান। কিন্তু যানজট কমছে না। আছে পানির সমস্যা। ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সর্বোচ্চ এক কোটি ৩০ লাখ মানুষকে প্রতিদিন পানি সরবরাহ করে তারা। বাকি মানুষ কীভাবে পানির প্রয়োজন মেটায়, তা ওয়াসার জানা নেই। এককথায় শহরে নাগরিক সেবা তলায় ঠেকেছে। সাত বছর পর জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেলে নাগরিক দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

নগর গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, ঢাকার বহুমুখী সংকট এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। ঢাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে চিন্তাভাবনার অস্বচ্ছতা, পরিকল্পনা প্রণয়নে সময়ক্ষেপণ ও বাস্তবায়নে অনীহা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নগর প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণে অনিচ্ছা এবং সম্পদের অপ্রতুলতা ও অপব্যবহার এই সংকট তৈরি করেছে। আবার অপরদিকে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ঢাকাকে বলছেন সুযোগের শহর (সিটি অব অপরচুনিটি)। তাঁর মতে, ১৮ লাখ পোশাকশ্রমিক, ১০ লাখ নির্মাণশ্রমিক এবং পাঁচ/দশ লাখ রিকশাচালকের জীবিকার সুযোগ করে দিয়েছে ঢাকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক নূর-উন-নবী গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা হচ্ছে দেশের ক্ষমতাবান ও ধনিক শ্রেণীর শহর। যাদের অর্থ-বৈভবের শেষ নেই, এ শহর তাদের। একই সঙ্গে যারা নিঃস্ব, একেবারেই কিছু নেই, এ শহর সমানভাবে তাদেরও। তিনি বলেন, পেশায় যারা দক্ষ, এ শহরে তারা কাজ করে। যাদের শরীর আর পেশীর জোর ছাড়া কিছুই নেই, তাদেরও কাজের অভাব হয় না এখানে। আর তাই, টাকার দরকার হলে মানুষ ঢাকার উদ্দেশে ছোটে।

ইতিমধ্যে বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকা পরিচিতি পেয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য ছিল। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো এই পাঁচটি বিষয়ে ৩০টি সূচক ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। সেখানে ১৪০টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে বিবেচিত হয় ঢাকা।
নিপোর্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক সুব্রত ভদ্র গণমাধ্যমকে বলেন, সুযোগ-সুবিধার আকর্ষণে মানুষ ঢাকায় চলে আসছে। একে বলা হয় পুল ফ্যাক্টর। আবার নদীভাঙনের মতো ঘটনায় মানুষ সব হারিয়ে বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসছে। একে বলা হয় পুস ফ্যাক্টর। তিনি বলেন, মানুষ শিক্ষার জন্য আসছে, ভিক্ষার জন্যও আসছে। সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৮২টি। এর মধ্যে ৬০টি ঢাকা শহরে। সারা দেশে মোট ৭৫টি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ২৮টি ঢাকা শহরে। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, মানের দিক থেকেও দেশের সেরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এই শহরে কেন্দ্রীভূত। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় এক কোটি সাত লাখ ৭৩ হাজারের কিছু বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩০ লাখ ৩০ হাজার (২৮ শতাংশ) শিক্ষার্থী ঢাকা বিভাগে।

বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ড এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫৪টি ওয়ার্ড নিয়ে রাজধানীর সীমানা। এর মধ্যে ডিএসসিসির আয়তন ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গকিলোমিটার। ডিএসসিসির তথ্য মতে, এখন ডিএসসিসিতে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষের বাস। অন্যদিকে ডিএনসিসির আয়তন ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। এখানে প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বাস।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ১১তম। কিন্তু আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। এই জনঘনত্ব অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক। পৃথিবীর আর কোনো অংশের জনপদের মানুষ কখনো এত ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে বসবাস করেনি। এ সমস্যা থেকে বাঁচতে যত দ্রুত সম্ভব বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়ন করতে হবে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রস্তাবিত ড্যাপে জনসংখ্যা ও চাহিদার বিশ্লেষণে বিস্তর তথ্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শহর নিয়ে পরিকল্পনার মূল উপজীব্য হচ্ছে শহরের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা শহর নিয়ে পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এই শহরে কত মানুষ হবে, তাদের চাহিদা কেমন হবে, সেসব বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে।

নতুন ড্যাপ প্রণয়নের কাজ চলছে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের কথা মাথায় রেখে (প্রথম খণ্ড, অনুচ্ছেদ ১.২.৩)। এ সংক্রান্ত আরও তথ্যের বিশদ উপস্থাপন হয়েছে খসড়া প্রতিবেদনের দ্বিতীয় খণ্ডের ১.২ অনুচ্ছেদে। উপ-অঞ্চলভিত্তিক বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য (প্রক্ষেপিত) জনসংখ্যা, চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার তালিকাও খসড়া প্রতিবেদনের দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিতভাবে আছে। এ ছাড়া একটি এলাকায় কত মানুষ থাকবে, ওই সব মানুষের নাগরিক সেবার মান কেমন হবে-পরিকল্পনায় সে বিষয়ে আলোকপাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রতিটি এলাকারই একটি নিজস্ব ধারণক্ষমতা থাকে। ধারণক্ষমতা অতিক্রম করলে তার চাপ সব ধরনের সেবার ওপরই পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়। সে আলোকেই ড্যাপে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এসেছে। যথাযথভাবে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ও এমজিসি মেনেও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ‘এফএআর’র মান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর মান বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় জনসংখ্যার চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

ডিএসসিসির নগর পরিকল্পনা বিভাগের সূত্রে জানাযায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ঢাকা শহরে যতটুকু জলাভূমি ছিল, তা গত ৫০ বছরে ৮৫ শতাংশ হারিয়ে গেছে। এসব জলাভূমি ভরাট করে বাড়িঘর স্থাপন করা হয়েছে। যে কারণে ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা রয়েছে।
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব গণমাধ্যমকে বলেন, স্বাধীনতার পরের ঢাকা আর আজকের ঢাকা এক নয়। স্বাধীনতার পর ঢাকার জনসংখ্যা যেমন কম ছিল, সমস্যার পরিমাণ ছিল কম। এখন জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা পাহাড় পরিমাণ বেড়েছে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না। তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে ঢাকাকে বিস্মৃত করতে পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। কিন্তু নানা কারণে আজও সেই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। এখন ঢাকার সঙ্গে আশপাশের জেলার সংযোগ সড়ক উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়া যত দ্রুত সম্ভব বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ; নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা শহরের একক কেন্দ্রিকতা কমাতে সমগ্র দেশের সার্বিক সুষম উন্নয়নে ঢাকাসহ সব নগরের জন্য ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, পরিবহন পরিকল্পনা, ড্রেনেজ পরিকল্পনাসহ অন্যান্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা খুব জরুরি। সময়মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে আমাদের সমস্যার আবর্তেই ঘুরপাক খেতে হবে। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামাজিক সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় এনে সঠিকভাবে শহরের অন্তর্ভুক্তিমূলক জনবান্ধব পরিকল্পনা তৈরি হবে। তবে সবকিছুর ওপরে আছে একটি ভালো নগর পরিচালন পদ্ধতি। সুশাসন নিশ্চিত না করে ভালো শহর গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

https://dailysangram.com/post/449860