১৭ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ৩:০৫

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে সংকটাপন্ন রোগীর ভিড়

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে সংকটাপন্ন রোগীর ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ শুরুর পর রোগীদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। এ কারণে সংকটাপন্ন রোগী নিয়ে স্বজনরা হাসপাতালে ছুটছেন। ফলে অনেকে হাসপাতালে এসেও অক্সিজেন, আইসিইউ, এমনকি লাইফ সাপোর্ট সুবিধা পেলেও শেষ পর্যন্ত হেরে যাচ্ছেন ভাইরাসের কাছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের শুরুতে চরম অবহেলার কারণে এ অবস্থা তৈরি হচ্ছে। এদিকে লকডাউনে হাসপাতালে রোগীর চাপ কমলেও আইসিইউ সংকট আরো বেড়েছে। শয্যা না পেয়ে মুমূর্ষু রোগীরা ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। কমেছে করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে আসা লোকজনের উপস্থিতিও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় দিনভরই করোনায় বিপন্ন মানুষের এমন উপস্থিতি চোখে পড়ে। আইসিইউ সংকট যেন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। আর তাই বাড়ছে হাসপাতালে থেকে হাসপাতালে অসহায় রোগীদের ছোটাছুটিও। স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হওয়ার পর হাসপাতালে রোগীর চাপ কিছুটা কমেছে।এখন অনলাইনের মাধ্যমে সিরিয়াল নেওয়ার সময় বলে দেওয়া হয় রোগীকে। সে সময়েই আসেন রোগী। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আইসিইউ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক হাসপাতাল ঘুরে ফিরে ভাগ্য ভাল থাকলে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার পর্যন্ত ১ হাজার ১শ’ ৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার ভঙ্গ হয়েছে একদিনে মৃত্যুর রেকর্ড। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ১০১ জন।

বিএসএমএমইউর আইসিইউ বিভাগের কনসালটেন্ট সাজ্জাদ হোসেন বলছেন, এখন শুরুতেই দ্রুত সংকটাপন্ন হওয়ার পরে হাসপাতালে আসছেন অনেক রোগী। আবার হাসপাতালে এসেও অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব করছেন। তিনি বলেন, আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের ফুসফুস দ্রুত সংক্রমণ হচ্ছে ফলে খুব দ্রুত ড্যামেজ হচ্ছে। ফুসফুস ফুটবলের মতো হয়ে যায়। আমাদের এখানে যত রোগী আসছে প্রায় সবার একই অবস্থা। আমরা চেষ্টা করছি সবদিক দিয়ে। অনেকে আবার দ্রুত লাইফ সাপোর্ট সুবিধা নিতে রাজী হয় না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সেকেন্ড ওয়েভ শুরুর আগে দু'মাস মানুষ যেমন গুরুত্ব দেয়নি তেমনি কর্তৃপক্ষের দিক থেকেও সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। গতবার ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়ছিলো। রোগটিতো চলে যায়নি। একটু কমে গিয়েছিলো। কিন্তু রোগটা আবার যখন মাথাচাড়া দিবে তখন তো এমনিই হবে। জনগণেরও যেমন অবহেলা আছে আবার যাদের প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিলো পাবলিক হেলথ থেকে সেটিও আমরা করিনি। বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবি'র গবেষণা করোনা ভাইরাসে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়ার পর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা এটিকে আরও বেশি সংক্রামক ও জটিল বলে বর্ণনা করেছেন।

এবার দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ শুরুর পর রোগীদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে অনেকে হাসপাতালে এসেও অক্সিজেন, আইসিইউ, এমনকি লাইফ সাপোর্ট সুবিধা পেলেও শেষ পর্যন্ত হেরে যাচ্ছেন ভাইরাসের কাছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গত সাতই এপ্রিল যে ৬৩ জন ও দশ এপ্রিল যে ৭৭ জন মারা গেছে তাদের সবাই হাসপাতালেই মারা গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছেন, বছরের শুরুতে চরম অবহেলার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যারা সংক্রমিত হয়েছেন তারা মনেই করেননি যে এটা করোনা। তারা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভেবে চুপ ছিলেন। প্রথম থেকে গুরুত্ব দিলে গুরুতর অবস্থায় যাওয়ার আগেই প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হতো। তাহলে এ অবস্থা হতো না।

তবে এবার দ্বিতীয় দফার সংক্রমণে ঢাকার বাইরেও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য আসছে। সে অনুপাতে চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল হওয়ায় জেলা ও উপজেলায় চিকিৎসা নিয়েও অবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেকে ঢাকায় আসছেন। ঢাকার কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন এসব বিলম্বে আসা রোগীদের পরে সারিয়ে তোলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে ঢাকার হাসপাতালগুলো এখন রোগীতে সয়লাব। আইসিইউ সুবিধা প্রায় দুর্লভ। ফলে সংকটাপন্ন অবস্থায় এসে রোগী সময়মত হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। আর হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব বিষয়ই ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সংক্রমণ এবং মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় আক্রান্তদের সেবাদানের ক্ষেত্রে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরাও। সাধারণত রোগী সুস্থ হলে অথবা মৃত্যু বরণ করলেই যেহেতু কোনো একটি আইসিইউ বেড খালি হয় তাই রোগী বাড়তে থাকায় আইসিইইউ সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে । রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদেরও সেবা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে আক্রান্তদের স্বজনরা অনেকেই বলছেন, ঢাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর জন্য প্রয়োজন হলেই একটা আইসিইউ সজ্জা পাওয়া যে কারো জন্যই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ বা মধ্যবিত্ত, যারা সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেড খোঁজেন তাদের জন্য এ সংকট আরো প্রকট হয়ে যায়।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয় ঢাকার ইব্রাহীম মজিদ নামের এক ব্যক্তি জানান, তিন দিন আগে তার মায়ের জন্য একটি আইসিইউ সজ্জা জোগাড় করতে সরকারি বেসরকারি প্রায় ৫০টি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হয়েছে। পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতায় প্রায় সাত ঘণ্টার চেষ্টায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সজ্জার ব্যবস্থা হয়। আমার মা কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কিন্তু অক্সিজেন লেভেল অনেক কমে যাওয়ায় তার আইসিইউ প্রয়োজন হয়। ডাক্তার এসে যখন বলে যে তার আইসিইউ প্রয়োজন কিন্তু ওখানে খালি নেই তখন বিভিন্ন জায়গায় কল দেয়া হয়। সরাসরি কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েও খোঁজ করা হয়, কিন্তু সাথে সাথে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না।" বলেন মি. মজিদ।

অসহায়ত্ব তুলে ধরে মজিদ বলেন, তখন পরিবারের সদস্যরা এবং বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ফোন করা হয়। প্রায় সাত ঘণ্টার চেষ্টায় তারা একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইইউ বেড পেয়ে সেখানে তার মা'কে ভর্তি করেন।

"কোথাও ম্যানেজ হয় না, কোথায় পাওয়া যায় না। কিছু জায়গা আছে হ্যা আইসিইউ আছে কিন্তু সেন্ট্রাল অক্সিজেন বা সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। পরে অনেক খোঁজাখুজির পর একটা পাই সেখানে ভর্তি করি। পরে কথা বলে জেনেছি অ্যাপ্রক্সিমেটলি ৫০টার মতো হাসপাতালে যোগাযোগ করা হয়েছিল।

অনেকের জন্যই হাসপাতালে হাই ফ্লো অক্সিজেন সুবিধা প্রয়োজন হচ্ছে কিন্তু পাওয়া সহজ নয়। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন সেবিকা রুমানা খাতুন বলেন "আমি যে কেবিনে ডিউটি করতেছি সেখানে ৩০টা বেড আছে। ৩০টা বেডেই হচ্ছে কন্টিনিউ রোগী থাকতেছে। এখন হচ্ছে কমতেছে না রোগী। তিনি আরো বলেন এই বাড়তি রোগীর কারণে আমাদের নার্সদেরও বেশ চাপের মধ্য পড়তে হয়েছে। এটাও বাস্তবতা যে বেড খালি না থাকায় অনেক সময় নতুন রোগী আসলে ফিরিয়েও দেয়া হচ্ছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্যসহ ভাইরাসের নতুন কয়েকটি ভ্যারিয়ান্ট ছড়িয়ে পড়ায় অনেক বেশি রোগী হাসপাতালে অক্সিজেন এমনকি আইসিইউ সুবিধার প্রয়োজন পড়ছে বলেও জানা যাচ্ছে। কোভিড ডেডিকেডেট একটি সরকারি হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইশান জাহান বলেন “এখনকার অবস্থায় যেটা হচ্ছে। রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল ভাল আছে, কথা বলছে এরকম অবস্থায় হঠাৎ করে রোগী বলছে যে আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

এমনক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের ট্রিটমেন্ট শুরু করার সুযোগও অনেক সময়ও অনেক রোগী দিচ্ছেন না। অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে মারাও যাচ্ছে” বলেন তিনি।

স্বাস্থ্যকর্মী ইশান জাহান বলেন সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারছেন না যে পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক। যখন একজন রোগী নিয়ে হাসপাতালে যান তখন সেই ব্যক্তিটাই বুঝেন যে, হাসপাতালের একটা সিট পাওয়ার জন্য, একটা অক্সিজেনের সিলিন্ডারের জন্য, একটা আইসিইউ বেডের জন্য কী পরিমাণ হাহাকার চলছে"।

https://dailysangram.com/post/449884