১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:২৬

সিন্ডিকেটে জিম্মি এনসিটিবি

বিনামূল্যের বই ছাপার শুরুতেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর নেয়া সিদ্ধান্ত বিতর্ক জন্ম দিয়েছে। যেখানে কাগজের উপর নির্ভর করে বইয়ের মান নির্ণয় হয়। সেখানে এনসিটিবি কাগজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনুমোদনহীন পেপার মিল থেকে। এ অবস্থায় কাগজের ক্ষেত্রে মান অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিএম (সার্টিফিকেশন মার্কস) লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক বলে চিঠি দেয় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। বিএসটিআই সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে এবারও সিএম লাইন্সেসহীন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে।
এনসিটিবি’র সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সিএম লাইসেন্স বাধ্যতামূলক এমন শর্ত বহাল থাকার পরও সম্প্রতি ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক বইয়ের টেন্ডারের জন্য সিএম লাইন্সেসের কথা উল্লেখ করা হয়নি। সিএম লাইসেন্স ছাড়া ছাপা ও লেখার কাগজ বিক্রয়, বিতরণ ও বিজ্ঞাপন প্রচার করা বিএসটিআই অর্ডিন্যান্স, ৩৭ (১৯৮৫) ও বিএসটিআই (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০০৩ অনুসারে আইনত নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ কাগজ উৎপাদন করায় যেখানে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সেখানে এনসিটিবি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আইনগত সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাগজ কিনছে। এ বিধান অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা করছে না এনসিটিবি। দরপত্রে সিএম লাইসেন্স প্রদর্শন না করায় বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানও টেন্ডারে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে। এতে বইয়ের মান নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও একই প্রশ্ন উঠবে।
এনসিটিবির সূত্র বলছে, গত বছর সনদহীন পেপার মিলকে কাজ দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানান বিএসটিআই। টেন্ডার আহ্বান করা হয়ে গেছে- এমন অজুহাত দেখিয়ে গত বছর পার পেয়ে যায়। কিন্তু এবারও সেই একই কাজ করতে যাচ্ছে এনসিটিবি। এমন প্রেক্ষিতে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) প্রকৌশলী এস এম ইসহাক আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে (সিএম লাইন্সেসপ্রাপ্ত) ১৬টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠানো হয় এনসিটিবিকে। সেখানে বইয়ের মান নিশ্চিত করতে এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে কাউকে কাজ না দেয়ার অনুরোধ করা হয়। অথচ সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আহ্বান করা বিভিন্ন টেন্ডারে সিএম লাইন্সেসের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিএসটিআই থেকে পাঠানো তালিকায় যে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো- সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, হাসেম পেপার মিলস, পেপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ, আর নূর পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, পূর্বাচল পেপার মিলস (এবার নতুন লাইন্সেস পেয়েছে), কোয়ালিটি পেপার মিলস, সাউদার্ন ইস্টার্ন পেপার মিলস, বসুন্ধরা পেপার মিলস, বসুন্ধরা মাল্টি পেপার মিলস, গাজীপুর পেপার মিলস, এমএএফ নিউজ প্রিন্ট মিলস, পারটেক্স পেপার মিলস, আম্বার পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস, হাক্কানী পেপার অ্যান্ড পাল্প মিলস এবং সুইস কোয়ালিটি পেপার মিলস।
এনসিটিবি’র তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক ও মাদরাসার এবতেদায়ির বই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহ করা হয় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে। এতে দরদাতা প্রতিষ্ঠানই দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাগজ কিনে বই মুদ্রণ করে জেলা পর্যায়ে সরবরাহ করে। কেবল মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপা হয় স্থানীয় দরপত্রের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে এনসিটিবি নিজস্ব উদ্যোগে কাগজ কিনে দরপত্রের মাধ্যমে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করে। কিন্তু প্রাথমিকের বই মুদ্রণের আন্তর্জাতিক দরপত্রের শর্ত অনুসারে দরদাতা প্রতিষ্ঠান কী মানের কাগজ সরবরাহ করবে, তার নমুনা কাগজ জমা দিতে হয়। কিন্তু মাধ্যমিকের কাগজ কেনার ক্ষেত্রে নমুনা কাগজ জমা দেয়ারও শর্ত আরোপ করা হয়নি। এর ফলে মাধ্যমিকের বই ছাপার ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন কাগজ দেয়া হচ্ছে কিনা, তা যাচাইয়েরও আর সুযোগ থাকছে না।
অন্যদিকে এনসিটিবি’র কাগজ কেনা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি। সমিতির নেতারা বলছেন, এনসিটিবি’র কাগজ কেনা প্রয়োজন কেন? ৩৬ কোটি বইয়ের মধ্যে প্রায় ৩১ কোটি বইয়ের কাগজ, কালিসহ সব আমরা সরবরাহ করি। বাকি ৫ কোটি শিক্ষার্থীর পাঠ্যপুস্তক কাগজ কেনা ও মুদ্রণ করে এনসিটিবি’র তত্ত্বাবধানে। ৩৩ কোটি পারলে বাকি ৫ কোটি মুদ্রণকারীরা পারবে না- এমন প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, তার মানে যত কেনাকাটা তত অনিয়ম। যার প্রমাণ সিএম লাইন্সেস না থাকার পরও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কাগজ কেনা। মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা আরো বলছেন, নিম্নমানের কাগজ কিনলে আমাদের ধরার সুযোগ আছে। কিন্তু এনসিটিবি নিজেই যদি নিম্নমানের কাগজ কিনে তাদের কে ধরবে?
এনসিটিবি দীর্ঘদিন থেকে বিএসটিআইয়ের আইন উপেক্ষা করে এসেছে। এ কারণে গুণগত মানসম্মত কাগজ কেনার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে তাগিদপত্রও পাঠানো হয়েছে। ওই পত্রে বলা হয়েছে, কতিপয় প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের সিএম লাইসেন্স গ্রহণ না করে গুণগত মান যাচাই ব্যতীত অবৈধভাবে লেখা ও ছাপার কাগজ বিক্রয়/বিতরণ করে আসছে মর্মে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাজারে নিম্নমানের লেখা ও ছাপার কাগজের আধিক্য যেমন দেখা যাচ্ছে, পাশাপাশি সরকারও প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষা ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য ছাপার কাগজ কেনার ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের সিএম লাইসেন্স জমাদানের শর্তারোপ করার অনুরোধ জানানো হয়।


http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=59741&cat=2/-