১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:২৩

চার বছরে ৯০ ভাগ কমেছে হালদায় রেণু উৎপাদন

বিষাক্ত বর্জ্যে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্রটি ধ্বংসের মুখে

দেশের রুইজাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে ২০১২ সালে রেণু উৎপাদিত হয় এক হাজার ৫৬৯ কেজি। আর চার বছর পর ২০১৬ সালে উৎপাদিত হয় ১৬৭ কেজি রেণু। অর্থাৎ চার বছরে উৎপাদন কমেছে এক হাজার ৪০২ কেজি। শতকরা হিসেবে এ হার ৮৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য এটি। বেসরকারি গবেষকদের মতে, প্রকৃত সত্যটি আরো ভয়াবহ। তাদের দাবি, ২০১২ সালে হালদা থেকে সংগৃহীত রেণুর পরিমাণ ছিল ৩৫৪ কেজি, ২০১৩ সালে ৭০ কেজি, ২০১৪ সালে ২৭৫ কেজি, ২০১৫ সালে ৪৭ কেজি এবং ২০১৬ সালে মাত্র ১২ কেজি।
৩০ বছর ধরে হালদা নদী নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে হালদা দিনদিন হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, এর পেছনে নদীসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খালে স্লুইসগেট নির্মাণ এবং নদীতে পতিত গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। হালদাকে বাঁচাতে হলে দূষণ ও বালু উত্তোলন বন্ধ এবং হালদার মুখে নতুন জেগে ওঠা চর অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে জানান তিনি। গবেষণায় উঠে এসেছে, নদীর ১১টি স্থানের বাঁক সমান করে ফেলায় মাছের বিচরণ ও প্রজনন কমে গেছে। বাঁক না থাকায় প্রাকৃতিকভাবে কোনো কুম (নদীর তলদেশে গভীর খাদ, যেখানে আগে মা-মাছ ডিম ছাড়ত) তৈরি হচ্ছে না। উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় এখন মা মাছ নমুনা ডিম ছাড়ার পর আর কোনো ডিম ছাড়ছে না। ফলে দিন দিন নদীতে মা-মাছের ডিম ছাড়ার হার কমছে। এর বাইরে কিছু কিছু জায়গায় চর জেগে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবিরত শিল্পদূষণ, নদী ভরাট, দখল-বেদখলসহ বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্যে ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী। নদীর গতিপথে বিভিন্ন বাধাবিপত্তি, রাবার ড্যাম, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন দিন দিন নদীটিকে মা-মাছশূন্য করে তুলছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই নদীটি তার স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়ে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, হালদাকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় মানবসৃষ্ট এসব দূষণ ও প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহে বাধা প্রদান নদীটিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে। মা-মাছ নিধন, নদীর বাঁক কেটে ফেলা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং সরকারের উদাসীনতাকে হালদা দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।
গত বছর চালানো চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নদীর নিকটবর্তী আট প্রতিষ্ঠানের কারণে মূলত দূষিত হচ্ছে হালদার মৎস্য প্রজনন। প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় ট্যানারির তরল বর্জ্য এবং গৃহস্থালির বর্জ্যরে মাধ্যমে দূষিত হচ্ছে হালদা। নদীর সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন খাল ও ছোট ছোট ছড়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে এ দূষণ। তদন্ত প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, বায়েজিদ-অক্সিজেন এলাকার আবাসিক বর্জ্য বামনশাহী খালের মাধ্যমে হালদায় পড়ছে। আগে বামনশাহী খালের পানি সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে পড়ত। কিন্তু এখন তা অনন্যা আবাসিক এলাকার ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি কুয়াইশ খালের মাধ্যমে হালদায় পড়ছে। এতে হালদা ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে এবং নদীপাড়ের লোকজনের সাথে কথা বলে তৈরি করা পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃত্রিম সেচের জন্য হালদার অনেক জায়গায় স্লুইসগেট তৈরি করা হয়েছে। আবাসিক, শিল্প ও ট্যানারির বর্জ্য এসে পড়ছে হালদা নদীতে। হাটহাজারী উপজেলা মদুনাঘাট এলাকায় খন্দকিয়া খালে তরল বর্জ্যরে পাশাপাশি পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনসহ গৃহস্থালির বর্জ্য। হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা এলাকায় শাহ মাদারি খাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পানির সাথে ভাসমান বর্জ্য পড়ছে হালদায়। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও হালদা নদীর উত্তর মাদার্শা ও গড়দুয়ারা এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলছে।
দেশের রুইজাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী। এক সময় এ নদী থেকে রেণু সংগ্রহ করে সারা দেশের চাহিদা মেটানো হতো। চট্টগ্রামের ৬০ লাখের বেশি মানুষের দৈনন্দিন পানি সরবরাহ করা হয় এ নদী থেকে। তা ছাড়া খাগড়াছড়ির পাতাছড়ি থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর দুই পাশের মানুষ এর ওপর নির্ভরশীল। এতসব দিক দেকে গুরুত্বপূর্ণ এ নদীটিকে রক্ষায় এখনই সবাই এগিয়ে না এলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এর শুধু ইতিহাসই পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/208536