১০ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ১:১৮

আসামির পরিবর্তে নিরপরাধীর কারাভোগ

জবাবদিহির অভাবে দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্য

দায়ীদের সাজার নজির নেই - হাইকোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষিত - ক্ষতিপূরণের মামলায় কম আগ্রহ ভুক্তভোগীদের

ঋণখেলাপির এক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আশরাফ আলীর পরিবর্তে দিনমজুর মিন্টু মোল্যাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যশোরের বেনাপোলের দিঘিরপাড় এলাকায় আশরাফ আলী ও মিন্টুর বাড়ি। বাবার নামের মিল থাকায় (দুজনেরই বাবার নাম মোহর আলী) গত বছরের ১৬ নভেম্বর মিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়। বেনাপোল পোর্ট থানার এসআই মাসুম ও একই এলাকার চৌকিদার কালা কবির তাকে গ্রেফতার করেন। ওই সময় নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি (মিন্টু) আশরাফ নন বলে দাবি করলেও কোনো কথাই শুনতে রাজি হননি দারোগা ও চৌকিদার।

এরপর তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে গিয়ে দরবার ফাইলেও অভিযোগ করেন মিন্টু। তাতেও কাজ হয়নি। এরপর ৬ মার্চ যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে আসেন আইন মন্ত্রণালয়ের দুজন উপসচিব। ওই সময় মিন্টু তাদের কাছে বিষয়টি বলেন। তারা বিষয়টি লিগ্যাল এইডের কর্মকর্তাদের খতিয়ে দেখতে বলেন। গত ১১ মার্চ লিগ্যাল এইডের সহায়তায় জানা যায়, সাজাপ্রাপ্ত আশরাফ অন্য ব্যক্তি। ফলে সেদিনই মিন্টুকে খালাস দেন যশোরের যুগ্ম দায়রা জজ ও স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৬-এর বিচারক।

শুধু মিন্টু মোল্যাই নন, আসামির নামের মিল, বাবার নামের মিল কিংবা ভুয়া পরোয়ানায় নিরপরাধে কারাভোগের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। বিনা দোষে জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কারাভোগ করতে হচ্ছে। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের নজরে এলে আদালত তাৎক্ষণিক কারামুক্তির ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে আসামি গ্রেফতার বা গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের এ বিষয়ে তেমন কোনো জবাবদিহিতা থাকে না।

এমনকি এমন কাজের জন্য তাদের সাজার নজিরও নেই। পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা ও জবাবদিহিতার অভাবে দুষ্টচক্র প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে অবলীলায়। এ সিন্ডিকেটে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, পুলিশ ও আদালতের কর্মচারীরা জড়িত বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো আইনের শাসনের দেশে এ ধরনের (বিনা দোষে কারাভোগকারী) ভুক্তভোগীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণের মামলা করেন। আমাদের দেশেও এ ধরনের মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী ও আইনজীবী মহলে সচেতনতা অল্প বলে তেমন কিছু করা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মো. আব্দুল্লাহ আবু বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা সাধারণত কোর্ট (আদালত) থেকেই জারি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে পরোয়ানা সঠিক নাকি ভুয়া, তা তাৎক্ষণিক পুলিশের পক্ষে যাচাই করা কঠিন। একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরি করতে হলে কোর্টের সিল-স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। আর মূলত কোর্টের কিছু অসাধু স্টাফই এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এই অসাধু স্টাফদের সহায়তায় প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে একটি দুষ্টচক্র ভুয়া পরোয়ানা জারির মতো অন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। তবে কোনোভাবেই যেন নিরপরাধ ব্যক্তি সাজা না-পান, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পরোয়ানা তামিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, যদি কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হয়রানির উদ্দেশ্যে নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন কিংবা গ্রেফতারি পরোয়ানা নকলের বিষয়টি জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন, তাহলে অবশ্যই সেই কর্মকর্তা বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। একইসঙ্গে ভুক্তভোগীরাও প্রচলিত আইনে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, পরোয়ানা তামিলের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু পরোয়ানা জারি কিংবা তৈরির ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো হাত নেই। একটি ভুয়া পরোয়ানা তামিলের জন্য থানায় আসলে তা দেখে নকল বোঝার কোনো উপায় নেই। ফলে পুলিশ তা তামিল করলে এতে পুলিশের ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল থাকে না। আর ইচ্ছাকৃত ভুল না-হলে তাকে সাজা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

হাইকোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষিত : গত বছরের ১৪ অক্টোবর হয়রানি কমাতে ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা রোধে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যুর সময় গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৭৫-এর বিধানমতে নির্ধারিত ফরমে উল্লিখিত চাহিদা অনুযায়ী সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে তথ্যপূরণ করতে হবে।

যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা পরোয়ানা কার্যকর করবেন, তাদের নাম-পদবি এবং ঠিকানা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। যার প্রতি পরোয়ানা ইস্যু করা হচ্ছে অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা, মামলার নম্বর ও ধারা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট জজ (বিচারক)/ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরের নিচে নাম ও পদবির সিল এবং ক্ষেত্রমতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকের নাম ও পদবির সিলসহ বাম পাশে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট আদালতের সুস্পষ্ট সিল ব্যবহার করতে হবে।

গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তির (অফিস স্টাফ) নাম, পদবি ও মোবাইল ফোন নম্বরসহ সিল ও তার সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর ব্যবহার করতে হবে, যাতে পরোয়ানা কার্যকরকারী ব্যক্তি পরোয়ানার সঠিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ হলে পরোয়ানা প্রস্তুতকারীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে সঠিকতা নিশ্চিত হওয়া যায়। গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রস্তুত হলে স্থানীয় অধিক্ষেত্র কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট পিয়ন বইয়ে এন্ট্রি করে বার্তাবাহকের মাধ্যমে তা পুলিশ সুপারের কার্যালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠাতে হবে।

পুলিশ সুপারের কার্যালয়/থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্তৃক ওই পিয়নবইয়ে স্বাক্ষর করে তা বুঝে নিতে হবে। গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো ও কার্যকরের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ নির্দেশনা অদ্যাবধি মানা হচ্ছে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/410357