১০ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ১:১১

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকেই নাড়িয়ে দিবে

করোনা ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউ কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করা কতটা সম্ভব হবে তা বলা যাচ্ছে না। এর ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমবে বলে জানিয়েছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। চাকুরি হারিয়ে নতুন করে বেকার হবে কর্মজীবী মানুষ। এতে ছড়িয়ে পড়তে পারে দারিদ্রতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন গ্রামের মানুষ ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে।

করোনায় গোটা বিশ্ব অর্থনীতিই নাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশে^র অনেক দেশই তাদের লকডাউন প্রত্যাহার করে। এতে বিশ্ব নতুন করে অর্থনীতির মন্দা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চালায়। কিছু দেশ কাটিয়ে উঠলেও যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ইটালি ফ্রান্সসহ বড় দেশগুলো এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এরই মধ্যে আবারও করোনার তীব্রতা বেড়েছে। নতুন করে অনেক দেশই লকডাউন দিচ্ছে। এতে করে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সারা বিশে^ মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে।

করোনা ভাইরাসের প্রথম থাবায় একের পর এক নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল স্টেডিয়ামের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব বৈশ্বিক আয়োজন। কিছু দেশ নতুন করে আবার শুরু করলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা আবারও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। করোনার প্রথম আঘাতের চেয়ে দ্বিতীয় আঘাত শক্তিশালী মনে হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার কারণে লোকসানে পড়ছে বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলো। নতুন করে ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিদিনই ধ্বস নামছে প্রধান সব শেয়ার বাজারগুলোতে।

করোনা ভাইরাসের কারণে আয় কমে যাওয়ায় গ্রামের পরিবারগুলো সঞ্চয় হারাচ্ছে এবং ঋণের জালে আটকা পড়ছে। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী: একটি খানা জরিপের এ তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ জুড়ে প্রায় ১ হাজার ৬০০ খানায় সমীক্ষা চালানো হয়। এ সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চের তুলনায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ ও ব্যয় ৮ দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই পরিবারগুলোর প্রায় ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ করোনা মহামারির ফলে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, যার ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশই পুনরুদ্ধার হয়নি। সমীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরিবারের প্রায় ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারকে বিকল্প পন্থা হিসেবে ঋণ নিতে হয়েছিল এবং সেটি পরিশোধ করতে তাদের গড়পড়তা প্রায় দুই বছর সময় লাগতে পারে।

গবেষণায় বলা হয়, জরিপের জন্য অন্তর্ভুক্ত ১০টি প্রান্তিক গ্রুপের মধ্যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী, প্রতিবন্ধী, বস্তিবাসী ও চরের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের বাড়তি ব্যয় ও ঋণ পরিশোধে সহায়তা দরকার। সরকারিভাবে নগদ আর্থিক সহয়তা দিয়ে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বর্তমান করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে সাহায্য করা উচিৎ।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, করোনার অভিঘাত বহুমাত্রিকভাবে এসেছে, যার প্রভাব কর্মসংস্থান, আয়, সঞ্চয় ছাড়াও পুষ্টিহীনতা, সহিংসতা এবং শিক্ষা খাতে ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে লক্ষনীয়। স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি ও উন্নয়ন সংস্থাদের একত্রিত করে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিবে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে। চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্ধেক কমে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় এমনিতেই কমতির দিকে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ। অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানি। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যটির প্রধান বাজার। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে কারণে সেখানকার বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইটালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না। যেখানে ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ গত বছর। ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬২ ভাগ আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন তারা এরই মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়ার আঁচ পেতে শুরু করেছেন। কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারে শতকরা তিন দশমিক এক ভাগ বিক্রি এরইমধ্যে কমে গেছে, কমে যেতে শুরু করেছে ক্রেতাদের কার্যাদেশও।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই নিম্নমুখী। তার মধ্যেও ভাল করছিল রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬.৬৯ বিলিয়ন ডলারে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩.৫১ শতাংশ বেশি।
এ ছাড়া, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ২২.৬১ শতাংশ বেড়ে ১৭৮০.৫৫ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। যা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৪৫২.২০ মিলিয়ন ডলার।

তবে, জানুয়ারির তুলনায় প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ কমেছে ৯.২৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১৯৬২.২৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে হওয়ায় রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ কিছুটা কমেছে।

করোনার প্রভাবে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। শুধু চলতি বছর ৫০ ভাগ কমে অপরিশোধিত ব্রেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৩৩ ডলারে। এই পরিস্থিতি খুব সহসায় কাটবে এমন আভাস মিলছে না। কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীর হলে জ্বালানির চাহিদা এমনিতেই কমতে থাকে। অন্যদিকে তেলের উৎপাদন কমিয়ে বাজার সামাল দেয়ার বিষয়েও একমত হতে পারেনি সৌদি আরব ও রাশিয়া।

করোনা ভাইরাস দ্বিতীয় ঢেউ ছড়ানোর মতোই দ্রুতগতিতে বাড়ছে জীবাণুর ভয়। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা ধরনের জীবাণু-প্রতিরোধকের চাহিদা। কেমিক্যাল সংস্থাগুলির বিভিন্ন পণ্যের বিক্রিও বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকা শক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে। কমে যাবে বেচাকেনা। চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে।

আবার বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যে হারে বাড়ছে তাতে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্যে।

বাংলাদেশ করোনার প্রথম ধাক্কা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার দ্বিতীয় ঢেউ তীব্র হচ্ছে। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে। একই সাথে হারাতে পারে কর্মসংস্থান। এতে করে দারিদ্রতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনিতেই গ্রামের মানুষ ঋণের জালে আটকে পড়েছে। তা আরও কতটুকু গড়ায় তা দেখার বিষয়।

https://dailysangram.com/post/449176