৯ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৩:২১

টিকা নিয়ে ফের অনিশ্চয়তা

ভারতে সংক্রমণ কমা সাপেক্ষে জুনে রফতানি শুরু করতে পারে

সরবরাহে দেরি করায় সিরামকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার আইনি নোটিশ : কবে নাগাদ বাংলাদেশ টিকা পাবে সংশ্লিষ্টরা জানেন না

সহসাই টিকা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। ভারতে হঠাৎ করে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রুপ নেয়ায় সিরামেও টিকা ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে। ভারতে গত বুধবার রেকর্ড ১ লাখ ২৬ হাজার ৩১৫ জন নতুন রোগী সংক্রমণের শিকার হয়েছে। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি ভারতে প্রতিদিন টিকা দেয়া লোকের সংখ্যা বেড়ে ৩২ লাখ ডোজেরও বেশি দাড়িয়েছে। অথচ সিরাম ইনস্টিটিউটের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ লাখ ডোজের চেয়ে কিছুটা বেশি। তাই উৎপাদন থেকে ভারতে প্রতিদিন টিকার চাহিদা অনেক বেশি। এছাড়া বর্তমানে ভারতের ৬টি রাজ্যে চলছে নির্বাচন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভোটের আগে ভোটারদের খুশি করতে টিকার ব্যবস্থা করছে। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্ডারের সাথে বাড়তি দেশীয় চাহিদার ভারসাম্য রক্ষায় গত মাসে ভ্যাকসিন রফতানি স্থগিত করে ভারত। আর এখন নতুন করে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট বলছে, ভারতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমলেই কেবল আগামী জুন থেকে অক্সফোর্ড/ অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের রফতানি আবার শুরু করবে। প্রকোপ না কমলে কবে নাগাদ টিকা রফতানি শুরু করবে তার কোন সঠিক তথ্য জানা নেই সিরামের কাছে। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে সিরামের ৩ কোটি ডোজ টিকার প্রদানের চুক্তি রয়েছে আগামী জুন পর্যন্ত। এদিকে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করে দীর্ঘদিন থেকে টিকা আসবে আসবে আশায় থেকে অন্য উৎস না খুঁজে বিপাকে পড়ছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিস্টরাও সঠিক কিছু বলতে পারছে না। এমনকি এ নিয়ে কথা বলতেও রাজি নন। তবে কেউ কেউ এখনও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ টিকা পাবে বলে আশাবাদী। এদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা সংস্থার গবেষণালব্ধ করোনার টিকা তৈরি করছে সিরাম ইনস্টিটিউট। সেই টিকার সরবরাহে দেরি করায় সিরামকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।

সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা বলেছেন, সংস্থাটি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ভারতের চাহিদা পূরণকে অগ্রাধিকার দেবে, তবে ‘আমাদের দেশের প্রয়োজনের সাথে কোনো আপস না করে’ জুনে বহিঃদেশে রফতানি পুনরায় চালু করতে আশাবাদী। পুনাওয়ালা বলেন, ১শ’ ৪০ কোটি মানুষের দেশে সংক্রমণ যদি আরো বাড়তে থাকে তবে সংস্থাকে রফতানি আরো পেছাতে হবে। পুনাওয়ালা বলেন, ইউরোপ একই কাজ করছে। তারা রফতানি নিষিদ্ধ করেছে, আমেরিকা ভ্যাকসিনের জন্য কাঁচামাল নিষিদ্ধ করছে, তাই তারা ভ্যাকসিনের রফতানি নিষিদ্ধও করতে পারে। কারণ তারা অন্য ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন বাড়াতে বাধা দিচ্ছে।

আর সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে সময়মতো টিকা না পেলে ‘অন্য’ পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। অন্যান্য উৎস থেকে টিকা গ্রহণের কাজ চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সূত্র মতে, বাংলাদেশ ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালের মাধ্যমে তিন কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের চুক্তি করে। প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে ৬ মাসে এই টিকা পাওয়ার কথা। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ টিকা পায় জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ও ফেব্রæয়ারি মাসে ২০ লাখ। দুই মাসে মোট ৭০ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। ফেব্রæয়ারির ৩০ লাখ টিকা এখনও বাকি রয়েছে। এরপর মার্চ ও বর্তমান মাস এপ্রিল চলছে। সবমিলিয়ে এই সময়ে সিরাম থেকে বাংলাদেশের টিকা পাওয়ার কথা ছিল ২ কোটি ডোজ। অথচ এসেছে মাত্র ৭০ লাখ। প্রথম মাসের টিকা পেয়ে দেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করে। পাশাপাশি সিরাম থেকে টিকা পাচ্ছে বলে অন্যান্য উৎসের প্রতিও আগ্রহ কম ছিল সংশ্লিষ্টদের। তাই নতুন কোন উৎস খোঁজা হয়নি। কিন্তু যথাসময়ে টিকা না পাওয়ায় টিকাদান কার্যক্রম পুরোপুরি বাধাগ্রস্থ হয়েছে। এক সময়ে দিনে সোয়া ২ লাখেরও বেশি টিকা প্রদান করা হতো। মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও যা এখন নেমে এসেছে দৈনিক ১৩ হাজারে। অথচ দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু। গতকালও করোনায় রেকর্ড ৭৪ জনের মৃত্যু হয়। প্রতিদিনই শনাক্ত ৭ হাজার ছাড়াচ্ছে। করোনার প্রকোপ বাড়লেও টিকা না পেয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

সূত্র মতে, সিরামের তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার যে পরিমাণ বাংলাদেশকে দেবে বলেছিল, বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি ভারত। আর এক্ষেত্রে কাজ করছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির টিকা রাজনীতি। কিছুদিন আগেও ভোটের রাজনীতিতে টিকাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সিরাম ইনস্টিটিউটকে নতুন নতুন দেশকে টিকা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আর এরই প্রেক্ষিতে সঠিক সময়ে বাংলাদেশ টিকা পায়নি। বিভিন্ন দেশকে উপহার দেয়া, ভারতে হঠাৎ করে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রুপ নেয়া এবং সামনে ভোট হওয়ায় মোদি ভারতের সবাইকে টিকা প্রদানের চেষ্টা করায় সিরামেও টিকার ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে। যে কারণে মার্চ মাসে ভ্যাকসিন রফতানি স্থগিত করে ভারত।

ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দেশটিতে বর্তমানে প্রতিদিন টিকা দেয়া লোকের সংখ্যা বেড়ে ৩২ লাখেরও বেশি দাড়িয়েছে। অথচ সিরাম ইনস্টিটিউটের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ লাখ ডোজের চেয়ে কিছুটা বেশি। তাই ভারতে প্রতিদিন উৎপাদন থেকে টিকার চাহিদা অনেক বেশি। যদিও সেরাম ইনস্টিটিউট নয়াদিল্লির কাছে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে অনুমোদান চেয়েছে। এ বছর আগুন লাগার ফলে ভ্যাকসিন উৎপাদন মাসিক প্রায় ৭ কোটি ডোজ থেকে ১০ কোটি ডোজে উন্নীত করতে বিলম্ব ঘটছে। এরই ধারাবাহিকতায় কেবলমাত্র ঘরোয়া করোনাভাইরাস কেস কমলেই সিরাম ইনস্টিটিউট জুনে অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকা করোনা টিকার রফতানি আবার শুরু করবে। অন্যথায় এটা আরও বিলম্ব হতে পারে।

ব্রাজিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিতীয় ওয়েব দ্রুততর হওয়ার কারণে ভারতে গত বুধবার রেকর্ড ১ লাখ ২৬ হাজার ৩১৫ জন নতুন সংক্রমণের শিকার হয়। গত সপ্তাহে হোলি উৎসব শেষে ভারতে সংক্রমণ বেড়েছে।

সেরামকে আইনি নোটিস অ্যাস্ট্রাজেনেকার
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা সংস্থার গবেষণালব্ধ করোনার টিকা তৈরি করছে পুনের সেরাম ইনস্টিটিউট। সেই টিকার জোগানে দেরি করছে সংস্থা। তাই পুনের এই সংস্থাকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। আশঙ্কা অবশ্য গত মঙ্গলবারই প্রকাশ করেছিলেন সেরাম ইনস্টিটিউট সংস্থার প্রধান আদর পুনাওয়ালা। বলেছিলেন, এত বিপুল পরিমাণে করোনার টিকা কোভিশিল্ড তৈরি ‘খুবই চাপের’। ভারতে সেরাম ইনস্টিটিউট-এর কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেক-এর কোভ্যাক্সিন টিকা দেয়া হচ্ছে। এ টিকা নিয়ে সেরাম সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে ভারতের কেন্দ্র সরকার। স¤প্রতি কোভিশিল্ড বিদেশে রফতানি বন্ধ করেছে। কারণ দেশে করোনা লাগামছাড়াভাবে বাড়ছে। টিকার চাহিদাও বাড়ছে।

আদর পুনাওয়ালা জানিয়েছেন, সমস্যা এখানেই। কেন কোভিশিল্ড রফতানি করতে পারছে না তারা, সেকথা বিদেশে বোঝানো সহজ নয়। সেই কারণেই সম্ভবত আইনি নোটিস পেল সেরাম ইনস্টিটিউট।
আদর পুনাওয়ালা জানান, এখন মাসে তার সংস্থা টিকার ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি ডোজ উৎপাদন করছে। ১০ কোটি ডোজ ইতোমধ্যে কেন্দ্র সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। ৬ কোটি ডোজ রপ্তানি করেছে। দেশে বর্তমান চাহিদা পূরণ করতে এ উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। আর এ দেশ-বিদেশে টিকার চাহিদা মেটাতেই চাপে সেরাম ইনস্টিটিউট।

সূত্র মতে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার ৫০৭ জন। গতকাল দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে ৮১ লাখ ৩২৩ জন। এ পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৫৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮৩০ জন। এ পর্যন্ত টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৭৯০ জন। প্রথম ডোজ নেয়া টিকা গ্রহীতাদের জন্য দ্বিতীয় ডোজ প্রদান করতে হলেও দেশে টিকা দরকার প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ ডোজ। অথচ দেশে টিকা এসেছে সিরামের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৭০ লাখ এবং ভারতের উপহার হিসেবে দুই ধাপে ৩২ লাখ। সর্বমোট টিকার ডোজ ৯২ লাখ। অথচ এখন পর্যন্ত যারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন তাদের দুই ডোজ হিসেব করলে টিকা প্রয়োজন ১ কোটি ৪০ লাখ ডোজ। কিন্তু কিভাবে এই টিকা জোগাড় হবে, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। আর তাই টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্যখাত সশ্লিষ্টরা। আর এ টিকা না পাওয়ায় মানুষের মধ্যে প্রতিদিনই ক্ষোভ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (টিকাদান কর্মসূচি) ডা. শামসুল হক টিকা পাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মবর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তারা এ বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে দু’একজন এখনও টিকা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

https://www.dailyinqilab.com/article/372342