৯ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৩:১৩

করোনায় লাগামহীন মৃত্যু ও আক্রান্ত

প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড

আইসিইউ ও সাধারণ শয্যার তীব্র সংকট, নেই নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ - হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড়

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে দেশের করোনা পরিস্থিতি। লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। এক্ষেত্রে প্রতিদিনই হচ্ছে নতুন রেকর্ড। এ পর্যন্ত মৃত্যু ছাড়িয়েছে সাড়ে নয় হাজার। আর আক্রান্ত সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি। এরমধ্যে গত এক সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু এবং একই সময়ে শনাক্ত হয়েছে প্রায় অর্ধলাখ। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৭৪ জনের। একই সময়ে সাত হাজার ৮৫৪ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সব মিলিয়ে করোনার গোটা পরিস্থিতি একরকম লাগামহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পৌঁছায় মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। হাসপাতালগুলো রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অক্সিজেন ও আইসিইউ সংকটে শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরেও শয্যা পাচ্ছে না। অনেক রোগী আইসিইউ না পেয়ে হাসপাতালে কিংবা অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যাচ্ছেন। চিকিৎসার সুযোগ না-পেয়ে চোখের সামনে স্বজনদের মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে হচ্ছে অনেককে। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি হাসপাতালগুলোও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাবে রাজধানীতে কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট সাধারণ শয্যা আছে তিন হাজার ৬২২, এর মধ্যে খালি আছে ৪৩২টি। আইসিইউ শয্যা আছে ৩০৫টি। এরমধ্যে মাত্র ১৩টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা আছে। তবে সাধারণ রোগীদের অভিযোগ, সরকারি হিসাবে খালি দেখালেও বাস্তবে সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা পাওয়া যেন ‘সোনার হরিণ’।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাওয়া বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই তা স্বীকার করেছেন। বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আমরা কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করেছি। আগে দিনে দেড়শ পরীক্ষা হতো, এখন ৩৫ হাজার পরীক্ষা হচ্ছে। কোভিড রোগীদের সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও কোভিড নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কোভিডের কারণে নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আগামীতে এই দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রধানমন্ত্রীর ১৮ নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। তাহলে কোভিডকে তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। শুধু চিকিৎসা নয়, নমুনা পরীক্ষা করাতেও মানুষের ভোগান্তির অন্ত নেই। প্রতিদিন সকাল থেকে হাসপাতালগুলোয় পরীক্ষার জন্য লম্বা লাইন দেখা যায়। তীব্র গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে পরীক্ষা করাতে না-পেরে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কয়েকদিন এসেও পরীক্ষা করাতে পারছেন না। হঠাৎ করে পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় কিট ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারাও অতিরিক্ত পরীক্ষা করাতে পারছেন না। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পরীক্ষা করাচ্ছেন।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করাতে আসা মো. মামুন যুগান্তরকে বলেন, কয়েকদিন ধরে শরীরে জ্বর ও ব্যথা। তাই নিশ্চিত হতে নমুনা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু দুদিন হাসপাতালে এসেও পরীক্ষা করাতে পারলাম না। তিনি বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর কোনো পরীক্ষা করা হবে না বলে জানিয়ে দেয়। বাধ্য হয়েই পরীক্ষা না-করিয়ে ফিরে যাচ্ছি।

রূপগঞ্জের ব্যবসায়ী মুকুল আহমেদ করোনায় আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেন। কিন্তু রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি পাননি। এদিকে রোগীর পরিস্থিতি গুরুতর হতে থাকে। মুকুলের আত্মীয়স্বজন একটি আইসিইউ শয্যার জন্য প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শতচেষ্টা করেও কোনো শয্যা খালি পাওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষ রাজধানীর একটি হাসপাতালে আইসিইউতে থাকা এক রোগীর মৃত্যুর পর শয্যা খালি হলে সেখানে ভর্তি করা হয় মুকুলকে।

প্রভাবশালী হওয়ায় মুকুল নানা তদবিরের পর একটি আইসিইউ শয্যা পেয়েছেন। কিন্তু যারা সাধারণ রোগী তাদের অবস্থা কী, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু আইসিইউ নয়, সাধারণ শয্যার অভাবে মানুষ হাসপাতালেই ভর্তি হতে পারছে না। সীমাহীন কষ্ট নিয়ে অসহায়ভাবে তারা সৃষ্টিকর্তার ওপর সবকিছু ছেড়ে দিচ্ছেন।

করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা তীব্র হওয়ার পেছনের মূল কারণ হচ্ছে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে না-চলা-এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সামাজিক দূরত্ব না-মানা, নিয়মিত হাত না-ধোয়া, বেশি বেশি পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা না-থাকা এবং মাস্ক না-পরার কারণেই মূলত এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেই সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই সিটি করপোরেশন এলাকায় চালু হয়েছে গণপরিবহণ। আজ থেকে খুলবে শপিংমল ও বিপণিবিতান। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি আরও কঠোরভাবে মানতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুসতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, করোনা সংক্রমণ আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে হাসপাতালগুলো চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। রোগী ও স্বজনদের চরম ভোগান্তি ও কষ্ট হচ্ছে। সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলেও সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। তাই এখন থেকেই আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। ব্যক্তি সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়। সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সবকিছু বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালনের মধ্যদিয়ে আমাদের জীবিকাও চালিয়ে নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমাতে হলে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেককে নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি, বিশেষ করে মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার অভ্যাস, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। একইসঙ্গে টিকা নেওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে করোনাভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ ছড়াক-না কেন, সব ধরনের ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেই টিকা কার্যকর। এমনকি প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণের পর কেউ যদি আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে সুস্থ হয়ে দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, একদিনে মৃত্যুর রেকর্ড হলেও টানা চার দিন পর শনাক্ত সাত হাজারের নিচে নেমেছে। কমেছে শনাক্তের হারও। ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৭৪ জনের। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে নয় হাজার ৫২১ জনের মৃত্যু হলো। একদিনে নতুন করে আরও ছয় হাজার ৮৫৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে ছয় লাখ ৬৬ হাজার ১৩২ জন হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় দেশে সুস্থ হয়েছেন তিন হাজার ৩৯১ জন। এ নিয়ে সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৩০ জনে।

বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু হয়। এ বছর ৩১ মার্চ তা নয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। মঙ্গলবার এক দিনে ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। বৃহস্পতিবার সেই রেকর্ড ভেঙে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৭৪ জন হয়। সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পর এ বছর মার্চের শেষে প্রথমবারের মতো দেশে এক দিনে পাঁচ হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের খবর আসে। এর মধ্যদিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৯ মার্চ ছয় লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপর মাত্র এক সপ্তাহে সেই তালিকায় যোগ হয়েছে আরও অর্ধলাখ রোগী। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বুধবার দেশে রেকর্ড সাত হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে পরের দিনই তা প্রায় হাজার খানেক কমল।

এতে আরও বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৪৩টি ল্যাবে ৩৩ হাজার ১৯৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৪৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৫৮টি নমুনা। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৭০০টি। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হয়েছে ১২ লাখ ৩০ হাজার ৫৮টি।

নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৪৮ জন পুরুষ আর নারী ২৬ জন।

তাদের মধ্যে চারজন বাড়িতে এবং বাকিরা হাসপাতালে মারা যায়। মৃতদের মধ্যে ৪৬ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ১৬ জনের বয়স ৫১-৬০ বছর, ছয়জনের বয়স ৪১-৫০ বছরের মধ্যে, পাঁচজনের বয়স ৩১-৪০ বছর এবং একজনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল।

মৃতদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৪৩ জন, চট্টগ্রামের ১৫ জন, রাজশাহীর তিনজন, খুলনার সাতজন, বরিশালের চারজন ও সিলেট বিভাগের দুজন ছিলেন। করোনাভাইরাসে দেশে মৃত ৯ হাজার ৫২১ জনের মধ্যে সাত হাজার ১৩০ পুরুষ ও ২ হাজার ৩৯১ জন নারী।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/410038/