৯ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৩:১০

রাজধানীতে ডাস্টবিনে পোড়া ময়লার দূষণে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ

রাজধানীর মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় বড় কোনো শিল্পকারখানা নেই। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বা মেট্রোরেলের মতো উন্নয়ন কাজও চলছে না। তারপরও রাজধানীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস এই এলাকায়। কারণ মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের মোড়ের অপর পাশের রাস্তায় ময়লার ডাস্টবিনে পোড়া হয় ময়লা। শুধু মালিবাগই নয় রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে রাখা ময়লার কন্টেইনারগুলোতে এখন হরহামেশায় ময়লা পোড়া হচ্ছে। এই ময়লা ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান সড়কে ফেলে রাখা ডাস্টবিনেই তা পোড়ানোও হচ্ছে। ফলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে বিষ, যা মানব শরীরের জন্য বিপজ্জনক। দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয় খারাপ অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে রাজধানীতে বসবাসরত সকলেই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতার কাজটি করে না বললেই চলে। সেখানে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে ময়লা পুড়িয়ে দেয়। বায়ু গবেষকেরা বলছেন, সড়কে পড়ে থাকা ময়লার বড় অংশ থাকে প্লাস্টিক, যা পোড়ানোর কারণে ডাইঅক্সিন, ফুরান, মার্কারি, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলের মতো বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইডসহ অন্তত ছয়টি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়।

পরিবেশবিদরা বলছেন, এটা কোনভাবেই করা ঠিক নয়। এসব ময়লা আবাসিক এলাকা ও আশেপাশে পোড়ানোর ফলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া বিষ মানব শরীরে জায়গা করে নিচ্ছে। আর চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজালের রাজ্যে বসবাসকারী মানুষকে সুস্থ জীবনতো দিতেই পারছি না, উল্টো তাদের তৈরি করা বর্জ্যের কারণে তারাই মারাত্মক ঝুঁকিতেও পড়ছে। এছাড়াও ড্রেনের ময়লা আবর্জনা রাস্তার দুপাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় ধুলা-বালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ধুলা দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ধুলা দূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধুলা দূষণে জনদূর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। বায়ু দূষণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা।

২০১৭ সালে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায়, দেশের দূষণ পরিস্থিতির এই চিত্র উঠে এসেছে। অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়নের ফলে দেশের বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষ মারাত্মক বায়ু ও পানি দূষণের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণেই প্রতি বছর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক শতাংশের সমান ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশের জিডিপি বর্তমানে ২০ দশমিক ৮৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে শুধুমাত্র বায়ুদূষণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমান। বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট এনালিসিস ২০১৭ শিরোনামে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে যে বাতাস নিচ্ছে তা অত্যন্ত দূষিত। বিভিন্ন উৎস থেকে সিসা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়ামের মত ভারি ধাতু, সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস ও বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক মিশে বাতাসকে দূষিত করছে। দূষিত বাতাস মানুষের ফুসফুসে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করছে।

পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ মতে, দেশের শহরগুলোর রোজকার গার্হস্থ্য বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার টন, যার ৭০ শতাংশই পচনশীল জৈব বর্জ্য। এসব বর্জ্য প্রতিবছর ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে। এতে ক্রমাগত বাড়ছে বায়ুদূষণ। আর তা পোড়ালে সৃষ্ট ধোঁয়া বায়ুকে বিষাক্ত করে তোলে। পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট যে গুড়ো পদার্থ বাতাসে ছড়ায় তার বেশিরভাগই এতো ক্ষুদ্র কণা যা দৃশ্যমান নয়।যত্রতত্র ময়লা পড়ে থাকায় এবং এইসব ময়লায় দেওয়া আগুন ও ছাই পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের দূষণ ঘটাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে চলমান বর্জ্য পরিস্থিতি আগামী ৩০ বছরে আরও ভয়াবহ হবে। কেননা, এই সময়ে দেশে বিশেষত শহরগুলোতে গার্হস্থ্য বর্জ্যের পরিমাণ বাড়বে কয়েকগুণ।

কেন এত বেশি দূষণ, তা উঠে এসেছে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায়। গত ২০ মার্চ প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়, এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে ধোঁয়া তৈরি হয়। তাতেই বাতাসে বাড়তি দূষিত পদার্থ যোগ হয়। এই দাবির সত্যতা পাওয়া গেল সরেজমিনে গিয়ে। গত ২১ মার্চ কয়েক ঘণ্টা এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, কাঁটাবন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ আবাসিক এলাকা ঘুরে অন্তত সাতটি জায়গায় ময়লা পোড়ানোর পর রাস্তায় পড়ে থাকা ছাই দেখা যায়। এর মধ্যে একটি জায়গা ছিল এলিফ্যান্ট রোডে বাটার সিগন্যাল মোড় থেকে গাউছিয়া মার্কেটের দিকে যাওয়ার রাস্তার মুখে। বেলা একটার দিকে দেখা যায়, সেখানে ফুটপাতের কোনায় স্তূপাকারে পড়ে আছে প্লাস্টিকপণ্য, ককশিটসহ নানা আবর্জনা। তাতে পিট পিট করে আগুন জ্বলছে। কালো ধোঁয়া উড়ছে। একটু দূরেই আবদুল মতিনের ভাঙারির দোকান। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা প্রতিদিন ময়লা জড়ো করে এভাবে আগুনে পুড়িয়ে দেন। ১২ বছর ধরে তিনি সেখানে দোকানদারি করছেন। সব সময়ই এ দৃশ্য দেখে আসছেন।

স্ট্যামফোর্ডের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষণা বলছে, এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৮৩ শতাংশ। এ এলাকায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা দাঁড়িয়েছে ৪৫৮ মাইক্রোগ্রাম, যা দৈনিক ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয়। সড়কে ঝাড়ু দিয়ে জমা করা ময়লার একটা অংশ গভীর রাতে ফুটপাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সড়কে ময়লার বড় অংশ থাকে প্লাস্টিক, যা পোড়ানোর কারণে বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হয়। অবশ্য রাজধানীর কোনো এলাকায়ই নির্মল বায়ুর খোঁজ পাওয়া যায় না। ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানেই থাকে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী বৈশ্বিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের গতকাল সন্ধ্যার পর্যবেক্ষণে ঢাকা ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত শহর।

স্ট্যামফোর্ডের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের বড় কারণ রাস্তার ধুলা, খোঁড়াখুঁড়ি, নির্মাণকাজ, কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণসামগ্রী রাস্তায় ফেলে রাখা ও খোলা অবস্থায় পরিবহন। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ময়লা পোড়ানো। পাড়া–মহল্লায় বায়ুদূষণের এটি অন্যতম কারণ।

দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর একটি অংশ সড়কে জমা হওয়া। বড় সড়কগুলোতে ঝাড়ু দিয়ে ময়লা বিভিন্ন জায়গায় জমা করে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। কাজটি চলে রাত ৯টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত। অভিযোগ, সড়কে ঝাড়ু দিয়ে জমা করা ময়লার একটা অংশ গভীর রাতে ফুটপাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। শুধু এলিফ্যান্ট রোড এলাকা নয়, কাজটি চলে রাজধানীজুড়েই। কোথাও কম, কোথাও বেশি। স্ট্যামফোর্ডের গবেষকদের আরেকটি জরিপে এসেছে, ঢাকায় বেশি পরিমাণে ময়লা পোড়ানো হয় মোট ২৩টি জায়গায়। এর মধ্যে ১৩টি আবাসিক ও মিশ্র এলাকা, যেখানে বসতি আছে। ২১ মার্চ রাজধানীর খিলগাঁও, ধানমন্ডি, সেগুনবাগিচা এলাকা ঘুরেও বিভিন্ন জায়গায় রাতে ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোর পর ছাই পড়ে থাকতে দেখা যায়। ময়লা পোড়ানোর ধোঁয়ায় শরীরের তেজস্ক্রিয়া বেড়ে হৃৎপি- ও স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শিশুদের ফুসফুসের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে ধোঁয়ার ক্ষতিকর উপাদান। দীর্ঘ মেয়াদে এই ধোঁয়া ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকিও তৈরি করে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে সড়কে ময়লা পোড়ানোর দুটি কারণ জানা গেছে। প্রথমত, কাজে ফাঁকি দেওয়া। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের একটি অংশ ঝাড়ু দিয়ে আবর্জনা জড়ো করে তা গাড়িতে তুলে দেওয়ার কষ্টটি করতে চায় না। দ্বিতীয় কারণ, যে গাড়িতে করে ময়লা সরিয়ে নেওয়া হয়, তাতে অনেক সময় স্থান সংকুলান হয় না। আবার অনেক জায়গায় ময়লার গাড়ি নিয়মিত যায় না।

বাংলাদেশ লাং (ফুসফুস) ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ আসিফ মুজতবা মাহমুদ মিডিয়াকে বলেন, ময়লা পোড়ানোর ধোঁয়ায় শরীরের তেজস্ক্রিয়া বেড়ে হৃৎপি- ও স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শিশুদের ফুসফুসের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে ধোঁয়ার ক্ষতিকর উপাদান। দীর্ঘ মেয়াদে এই ধোঁয়া ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকিও তৈরি করে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের আব্দুল মতিন বলেন, এই বিষয়গুলো আমরা মনিটরের চেষ্টা করি। কিন্তু তারা রাতের আঁধারে পোড়ালে সেটা কেবল অন্যায়ই নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আমলে নেওয়া উচিত। ঢাকা ও এর আশপাশের ৫৯টি এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ছয় লাখ মানুষ সীসা দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। গবেষণায় সীসা দূষণের উৎস হিসেবে ব্যাটারি রিসাইক্লিং করা হয়ে এমন ২০টি এলাকা, সীসা গলানো হয় এমন ২৩টি এলাকা, চারটি মাল্টিপল ইন্ডাস্ট্রি বিভিন্ন শিল্প কারখানাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলায় সংক্রমণ অথবা ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা যেমন : ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। বায়ুদূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্কও দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

আন্তর্জাতিক জার্নাল কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, বায়ুদূষণকে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমেছে। অকালে মারা যাচ্ছে প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তেল, গ্যাস, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন দূষণ সৃষ্টিকারী কণার প্রভাব মানুষের ফুসফুসে প্রায় এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে।

গবেষণার প্রধান লেখক জস লেলিয়েভেল্ড বলেন, জনস্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে এই ক্ষতি কমানো সম্ভব। মহামারির তুলনায় বায়ুদূষণেই বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। ম্যালেরিয়ার তুলনায় ১৯ গুণ এবং এইডসের তুলনায় প্রায় ৯ গুণ বেশি মানুষ বায়ুদূষণের কারণে অকালে মারা যাচ্ছেন। বায়ুদূষণ থেকে কেবল ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন প্রায় ৬ শতাংশ মানুষ। এর প্রভাবে ফুসফুসের অন্যান্য রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশিয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। বায়ুদূষণের কারণে চীনে ৪ দশমিক ১, বাংলাদেশে ৪ দশমিক ৭, ভারতে ৩ দশমিক ৯ এবং পাকিস্তানে ৩ দশমিক ৮ বছর গড় আয়ু কমেছে। ধনী দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপ এবং দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে বায়ুদূষণ তুলনামূলকভাবে কম। ধনী দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং হাঙ্গেরিতে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয়। গবেষক টমাস মাঞ্জেল বলেন, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অকালমৃত্যুর জন্য মূলত মানবসৃষ্ট দূষণই দায়ী। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বছরে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষকে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।

এয়ার ভিজ্যুয়াল বাতাসের মানকে মোট ছয়টি স্কেলে পরিমাপ করে থাকে। এগুলো হচ্ছেগুড, মডারেট, আনহেলদি ফর সেনসেটিভ গ্রুপস, আনহেলদি, ভেরি আনহেলদি এবং হেজার্ডাস (বিপজ্জনক)। ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রাকে হেজার্ডাস বলেই অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যাচাইয়ের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়াল। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) কিছুদিন পূর্বে ঢাকার ধুলাদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। এতে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলা জমার হিসাব পেয়েছেন তারা। ঢাকার চারটি পার্ক ও উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির ৭৭টি গাছের পাতা সংগ্রহের পর এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণের জন্য ২০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো: ইটভাটা, রাস্তা নির্মাণ, পুনর্র্নিমাণ ও মেরামত, সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বড় উন্নয়ন প্রকল্প (এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল), সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্য নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহন, রাস্তায় গৃহস্থালি ও পৌর বর্জ্য স্তূপাকারে রাখা ও বর্জ্য পোড়ানো, ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা অনাবৃত স্থান, ফুটপাত ও রাস্তার আইল্যান্ডের মধ্যের ভাঙা অংশের মাটি ও ধুলা, ফিটনেসবিহীন পরিবহন থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর ধোঁয়া, বিভিন্ন যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি কলোনির ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো, বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলে দেওয়া, ঢাকা শহরের দূষণপ্রবণ এলাকার ধুলা, হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার এবং জনসচেতনতার অভাব। পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটার ধোঁয়া ৫৮ শতাংশ দায়ী। বাকি ৪২ শতাংশের জন্য দায়ী নির্মাণ ও মেরামতকাজের সঙ্গে আসা ধুলা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন থেকে বের হওয়া ধোঁয়া।

https://dailysangram.com/post/449036