৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ৩:০৭

উত্তরে খরা পরিস্থিতি

বরেন্দ্র ভূমিতে পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে না মধু মাসের ফল আম-লিচু-কাঁঠালের বর্তমান অবস্থা সপ্তাহখানেক চললে ধানের মারাত্মক ক্ষতি হবে

উত্তরে ভারত থেকে বাংলাদেশমুখী ছোট-বড় প্রায় সব নদ-নদীতেই বাঁধ, স্পার, রেগুলেটর নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার। অপরদিকে দেশের অভ্যন্তরে যথেচ্ছভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচ কাজে ব্যবহারের পরিণতিতে উত্তরাঞ্চলে পানির স্তর নিচে নামতে নামতে এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। তবে বেশি উদ্বেগজনক অবস্থা বরেন্দ্র অঞ্চলে বলে জানিয়েছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। এর সাথে যোগ হয়েছে অনাবৃষ্টির সমস্যা। বেড়েছে ভূমিকম্পের সময় ভূমিধসের আশঙ্কা।

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বরেন্দ্র বহুমুখী সেচ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএফ) বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন ও গবেষণা অ্যাকাডেমির (আরডিএ) একাধিক গবেষণা নিবন্ধের তথ্যানুযায়ী ১৯৮০ সালের শুরুতে বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর ছিল ৩৯ ফুট নিচে। বর্তমানে সেই পানির স্তর কোথাও ৮০ থেকে ৯০ ফুট আবার কোথাও ১১০ থেকে ১৬০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।
রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোরের অংশবিশেষ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। উল্লেখিত অঞ্চলের শহরগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পানির পাম্প আর ঠিকমতো কাজ করছে না বলে জানা গেছে। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজের জন্য নিয়োজিত সেচ পাম্পগুলোর অধিকাংশই অচল হয়ে পড়েছে।

বরেন্দ্র বহুমুখী সেচ উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের পরিচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা বর্তমানে ১৫ হাজার ১০০ বলে জানা গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তারা আর সেচ পাম্প বৃদ্ধি না করার নীতিগত অবস্থানে অটল রয়েছেন। তবে বেসরকারি পর্যায়ে গভীর থেকে গভীরতর পর্যায়ে সেচ পাম্প স্থাপনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এক হিসাব অনুযায়ী বোরো মৌসুমে সেচ কাজের জন্য বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে লক্ষাধিক সেচ পাম্প চালু রয়েছে। এতে সাময়িকভাবে বোরো ফসলের উৎপাদন হলেও দীর্ঘস্থায়ীভাবে প্রাকৃতিক ঝুঁকির মুখে পড়ছে উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে উঁচু বরেন্দ্র ভূমি এলাকা।

এ প্রসঙ্গে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির সাবেক ডিজি ও খ্যাতনামা পানি বিশেষজ্ঞ এম এ মতিন ইনকিলাবকে বলেন, একটি সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এখন ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং একই সময়ে নদীর পানি সংরক্ষণ করে গার্হস্থ্য কাজে সারা বছর ব্যবহার নিশ্চিত করার সময় এসেছে। এছাড়া বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় হার বৃদ্ধির জন্য উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমিতে বনায়ন প্রকল্প হাতে নিতে হবে। তাহলে আগামীর পানি সঙ্কট লাঘব হবে বলে তিনি মনে করেন।

পানি বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত একটি এনজিওর তথ্যে দেখা যায়, গত এক দশকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে এখন গড় বৃষ্টিúাতের পরিমাণ আড়াই হাজার মিলিমিটার। অথচ বরেন্দ্র অঞ্চলে এর পরিমাণ মাত্র ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বগুড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদের মতে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নগামী হলে আর্সেনিক দূষণের হার বেড়ে যায়। চিহ্নিত করে আর্সেনিক এলাকার পানি পানের ক্ষেত্রে পরিহার করা সম্ভব হলেও ওই দূষণযুক্ত পানিতে যে সবজি ও ধান বা ফল উৎপন্ন হবে সেটা খেলেও মানব দেহে আর্সেনিক দূষণ এড়ানো যাবে না।

ভূতাত্তি¡ক জরিপ অধিদফতরের সূত্রে জানা যায়, প্রতিবেশী ভারতের সিকিম ও আসাম বেল্টের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার লাগোয়া বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলোয় পানির স্তর নেমে গিয়ে যে ভ্যাকুম বা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে সেসব স্থানে ভূমিকম্পের সময় ভূমিধসের আশঙ্কা বেশি হতে পারে।

এদিকে চলতি বছরে গত তিন মাসে মাত্র দু’দফায় ধূলি ভেজানো মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ায় তাতে করে বিরাজমান তীব্র খরা পরিস্থিতির কোনোই উন্নতি হয়নি। আম, লিচু ও কাঁঠালের স্বাভাবিক বৃদ্ধি থমকে আছে। স্বাভাবিক বৃষ্টি না থাকা এবং সেচের অভাবে জমিতে বোরো ধান নিয়ে কৃষকরা চিন্তিত। এমন অবস্থা যদি সপ্তাহখানেক চলে তাহলে ধানের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে বৃষ্টি না হলেও উত্তরের ওপর দিয়ে তিন দফায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টির ঘটনায় ব্যাপক ফসল নষ্ট হয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে ১০ জনের।

https://www.dailyinqilab.com/article/371642/