৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ৩:০৫

স্বাস্থ্যবিধি কার্যকরে আইনি জটিলতা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রয়োজন পুলিশের কার্যকর ভূমিকা। গত বছর করোনার প্রকোপে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এবার মাঠে সেভাবে সক্রিয় নেই পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মতো এবারও মহামারি করোনায় সেবা দিতে চান পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণেই কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ওই আইনে বর্ণিত অপরাধসমূহ অধর্তব্য হওয়ায় করোনাসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ-প্রতিরোধে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। তাই ইতিমধ্যে সংক্রামক রোগ আইন-২০১৮ সংশোধনের আবেদন জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারও। পুলিশ সদর দপ্তরের সংশোধনী প্রস্তাবে নির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে জরিমানা করতে পারবে পুলিশ।
সংক্রামক রোগ আইনের ছয় ধারায় উপদেষ্টা কমিটির ক্ষেত্রে মহা-পুলিশ পরিদর্শককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ ও নিমূল আইন-২০১৮ আইনের সংশোধনী প্রস্তাব দেয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। করোনা সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তার রোধে লকডাউন কার্যকর করা, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, যানবাহন জীবাণুুমুক্ত করা, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ বহন, দাফন ইত্যিাদি বিষয়ে কার্যকরের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের আইনি ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে সংক্রামক রোগ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক সম্মুখভাবে অবস্থান করে তাই দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসারদের তাৎক্ষণিক জরিমানার ক্ষমতা দেয়া হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ সহজ হবে।
উদাহরণ হিসেবে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কর্তৃক জরিমানা আরোপের বিষয়টি ফলপ্রসূ হচ্ছে। সংক্রামক রোগ আইনের ছয় ধারায় উপদেষ্টা কমিটির ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাবনা হচ্ছে, উপদেষ্টা কমিটিতে ছয় ধারার উপ-ধারা (এক) এর পরে মহা-পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ- অন্তর্ভুক্ত হবে। যৌক্তিকতা হিসেবে এতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংক্রামক রোগের বিস্তার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে জন-জীবন বিপর্যস্ত হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে সাধারণ ছুটি ঘোষণাসহ লকডাউন, প্রয়োজনে কারফিউ জারি করতে হবে। সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করতে জনসাধারণের চলাচলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ সময় জরুরি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের প্রত্যক্ষভাবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হয়। বাস্তবতার নিরিখে জরুরি অবস্থার মোকাবিলা এবং লকডাউনসহ যথাযথ আইন প্রয়োগের জন্য পুলিশ বাহিনীর অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক বিধায় উপদেষ্টা কমিটিতে বাংলাদেশ পুলিশের মহা-পরিদর্শককে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। করোনকালে পুলিশের জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে পুলিশ প্রধানের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়।

সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল)’র ধারা-৬ অনুসারে উপদেষ্টা কমিটিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী থাকবেন চেয়ারম্যান। এই কমিটিতে থাকবেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিধপ্তরের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিপ্তরের মহাপরিচালক ও সরকার কর্তৃক মনোনীত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ দুইজন ব্যক্তি এই উপদেষ্টা থাকার নিয়ম রয়েছে।
ওই আইনের ধারা-১৯ এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘(এক) কোনো যানবাহন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বা পশুপাখি সংক্রামক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বলে যুক্তিসঙ্গতভাবে ধারণা হইলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী উহা জব্দ করিতে পারবেন।’ এই ধারার সংশোধনী প্রস্তাবনায় ‘ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী’র সঙ্গে ‘ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী বা বাংলাদেশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্ন্নে নহেন এমন কর্মকর্তা’- উহা জব্দ করিতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ধারা-২০ এ উল্লেখ রয়েছে, (এক) ‘যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগে মৃত্যু বরণ করেন বলিয়া সন্দেহ হয় তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির মৃতদেহ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর নির্দেশনা মোতাবেক দাফন বা সৎকার করিতে হইবে। (দুই) এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে।’ পুলিশ সদর দপ্তরের সংশোধনী প্রস্তাবে ‘ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর’- পরে উল্লেখ করা হয়েছে ‘বা বাংলাদেশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্নে নহেন এমন কর্মকর্তার নির্দেশনা মোতাবেক দাফন বা সৎকার করিতে হইবে।’ এতে গত বছরে করোনা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে যৌক্তিকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবার-পরিজন, ছেলে-মেয়ে তথা সন্তান তাদের নিজের বাবা-মা কিংবা নিজের সন্তানের মৃতদেহ দেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্য কিংবা প্রশাসন ব্যতিরেকে কাউকে দাফন বা সৎকারের জন্য পাওয়া যায় না। ফলে পুলিশ সদস্য তড়িৎ গতিতে আইন প্রয়োগ করার অতীত অভিজ্ঞতায় সংক্রামক রোগের তথ্য গোপনকারী, দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদানকারী বা নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপনকারী, মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইন প্রয়োগে সহায়ক হবে।

এই আইনে সংক্রমিত স্থান বা স্থাপনা জীবাণু মুক্তকরণ বা বন্ধকরণ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, কোনো স্থান বা স্থাপনায় সংক্রামক রোগের জীবাণুর উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হইবার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী নিম্নরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবেন: সন্দেহজনক স্থান, স্থাপনা বা প্রাঙ্গণ পরীক্ষা। সন্দেহজনক স্থান, স্থাপনা বা প্রাঙ্গণ জীবাণুমুক্তকরণের নির্দেশনা প্রদান। জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জনসাধারণের প্রবেশ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিতকরণ। বিধি দ্বারা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ। উপ-ধারা (এক) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, যে কোনো সন্দেহজনক স্থান, স্থাপনা বা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিতে পারিবেন।

এর সংশোধনী প্রস্তাবে ‘ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর’ পরে উল্লেখ করা হয়েছে ‘বা বাংলাদেশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্নে নহেন এমন কর্মকর্তার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, যে কোনো সন্দেহজনক স্থান, স্থাপনা বা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিতে পারিবেন।’ এতে যৌক্তিকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনটি প্রয়োগের মাঠ পর্যায়ের সিংহভাগ কাজ পুলিশ সদস্যদের করতে হয়। কিন্তু আইনে পুলিশের কোনো প্রকার কার্যক্রম গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়নি। তাই মাঠ পর্যায়ে আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের জন্য পুলিশের দায়িত্ববান কর্মকর্তাগণকে ক্ষমতা অর্পণ করা দরকার। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সংক্রামক রোধ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্নে নহেন এমন কোনো কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। ওই প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্ন্নে নহে এমন কোনো কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক অনূর্ধ্ব ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করিতে পারিবেন।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেল রানা জানান, সংক্রামক রোগ- প্রতিরোধ আইনে পুলিশকে কিছু সুনির্দিষ্ট সক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান আইনের পরিধির মধ্যে পুলিশের বাস্তব করণীয় অত্যন্ত সীমিত। ইতিমধ্যে স্বাভাবিক দায়িত্বের বাইরে গিয়ে পুলিশ সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=269238&cat=2